স্কুলের ৭৩.৫% কিশোর-কিশোরী মানসিক চাপে ভুগছে: গবেষণা
দেশের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী মাধ্যমিক স্কুলের কিশোর-কিশোরীদের একটি বড় অংশের মধ্যে যথাযথ ঘুম ও শারীরিক কার্যক্রমের অভাবে মানসিক চাপজনিত নানা উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। মানসিক চাপের ফলে ব্যাহত হচ্ছে তাদের দৈনন্দিন জীবন ও কর্মক্ষমতা এবং বাড়ছে স্বাস্থ্যজনিত জটিলতার ঝুঁকি।
বিএমজি সাইকিয়াট্রিতে গত ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধ অনুসারে, বাংলাদেশের স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীদের ৭৩.৫ শতাংশের মাঝেই মানসিক চাপজনিত কোনো না কোনো লক্ষণ দেখা গেছে। এর মধ্যে ৬৫ শতাশের মাঝে মাঝারি ধরনের মানসিক চাপের উপসর্গ দেখা গেছে। অন্যদিকে ৯ শতাংশ উচ্চচাপজনিত উপসর্গে ভুগছে। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেয়েদের মানসিক চাপ ছেলেদের চেয়ে বেশি ছিল। ছেলেদের মধ্যে এই হার ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও মেয়েদের মধ্যে তা ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
মানসিক চাপের ভুক্তভোগী কিশোর-কিশোরীদের থেকে ভবিষ্যতে স্বল্প দক্ষতা ও কর্মক্ষমতার তরুণ প্রজন্ম তৈরি হবে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাই তাদের সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক কারিকুলাম তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
গবেষকদের একজন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্সের সহযোগী অধ্যাপক ড. তাজউদ্দীন সিকদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের বাচ্চাদের মধ্যে স্ট্রেস, এংজাইটি, ডিপ্রেশন কী পরিমাণ আছে তা জানতে স্ট্রাকচারড কোশ্চেনিয়ারের মাধ্যমে আমরা এ গবেষণা করেছি। আমরা দেখেছি স্কুল ও পারিবারিক পরিবেশ বাচ্চাদের ওপর চাপ তৈরি করছে। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করার চাপ, পড়া বুঝতে না পারলে পিছিয়ে পড়ার চাপে পড়ছে তারা। এই জায়গাগুলোতে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। বাচ্চাগুলো যে পরিবেশে থাকে বিশেষ করে যেমন পরিবারে অভিভাবকদের এসব বিষয়ে সচেতন করা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। তাহলে তারা একটা চমৎকার পরিবেশ পেতে পারে'।
তিনি আরও বলেন, 'বাচ্চা সকালে উঠে স্কুলে যাচ্ছে সেখানে ক্লাসের পর ক্লাস করছে তারপর ছোট্ট একটা টিফিন পিরিয়ড পাচ্ছে। বিকেলে বাচ্চা ফিরলে আবার দুই-তিনজন শিক্ষক তাকে পড়াতে আসছে। নিজের জন্য তার সময় নেই। পুরোটাই অ্যাকাডেমিক ডেভলপমেন্টে দিচ্ছে। আমাদের স্কুলগুলোতে ডিবেট, কালচারাল অ্যাক্টিভিটির সুযোগ করে দিলে তাদের মধ্যে যে অ্যাংজাইটি আছে তা চলে যাবে। কীভাবে এই স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি বা ডিপ্রেশন থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখা যায় সেজন্য একটা কারিকুলাম তৈরি করতে হবে।'
'স্বাস্থ্য বলতে আমরা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্য বুঝি। কিন্তু শারীরিক স্বাস্থ্য যত ভালো হোক না কেনো, কারো মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ থাকলে, বিষণ্নতা থাকলে সে কোনো প্রোডাক্টিভ কাজ করতে পারবে না। সমাজে কোনো অবদান রাখতে করতে পারবে না। এখন যারা কিশোর ২০৩০ সালে তারা তরুণ হবে, তখন যে নাগরিক তৈরি হবে তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা বেশি থাকবে। কিন্তু মানসিক চাপে পর্যুদস্ত, বিষণ্ণ এক তরুণ প্রজন্মের কাছে খুব বেশি প্রত্যাশা রাখা যাবে না। মানসিক স্বাস্থ্য যখন খারাপ থাকবে তখন পারসোনাল ডেভলপমেন্ট হবে না, তাদের মধ্যে সব সময় খিটখিটে ভাব থাকবে', বলেন তিনি।
'স্ট্রেস সিম্পটমস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটেড ফ্যাক্টরস অ্যামং অ্যাডলসেন্টস ইন ঢাকা, বাংলাদেশ: ফাইন্ডিংস ফ্রম আ ক্রস-সেকশনাল স্টাডি'- শীর্ষক গবেষণা অনুসারে, উপসর্গ থাকা ৭০ শতাংশের বেশি কিশোর-কিশোরী ব্যয়াম, খেলাধুলার মতো শারীরিক কার্যকলাপে যুক্ত নয়।
একইভাবে তিন-চতুর্থাংশ কিশোর-কিশোরীর মধ্যে স্ট্রেস সিম্পটম বা মানসিক চাপের লক্ষণগুলোর সঙ্গে বিনোদনের ক্ষেত্রে স্ক্রিনটাইম ও অপর্যাপ্ত ঘুমের সম্পর্ক পাওয়া যায়। এছাড়া অতিরিক্ত ওজনের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও স্ট্রেস বা মানসিক চাপ অন্যদের চেয়ে বেশি ছিল। এমনকি ওজনের জন্য বুলিং-এর স্বীকার হওয়াও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মানসিক চাপের সৃষ্টি করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে স্কুলের চাপ, প্রযুক্তির ব্যবহার ও অ্যাকাডেমিক চাপ কিশোর-কিশোরীদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। অর্থাৎ, মানসিক চাপের সঙ্গে ঘুমের দ্বিমুখী সম্পর্ক থাকার ইঙ্গিত মিলে।
২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা জেলার শহুরে, মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ২,৩৫৫ জন শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে ক্রস-সেকশনাল গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ধানমন্ডি (শহর) এলাকার ১৬টি, সাভার (আধা-শহর) এলাকায় ১৪টি এবং ধামরাই (গ্রামীণ) এলাকায় ১৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেয়। এই গবেষণার পপুলেশন বা সমগ্রক ছিল ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির কিশোর-কিশোরীরা ১২-১২ বছর বয়সী), কারণ বাংলাদেশে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে চাপ ছিল সবচেয়ে কম যা প্রায় ৩২ শতাংশ।
গবেষণার আরেক গবেষক অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির ড. এম তাসদিক হাসান টিবিএসকে বলেন, 'সব স্কুলে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ করা একটি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। পাঠ্যক্রম সংশোধনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা ও স্টিগমা কমাতে ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা উচিত। গবেষকদেরও বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা উচিত। এছাড়া জেন্ডার সংবেদনশীল বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। সীমিত সংখ্যক মনোচিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানী থাকার বিষয়টি বিবেচনা করে অন্যদেরও সাইকোলজিকাল কাউন্সিলর হিসেবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।'