অবসায়নের পথে ঋণে জর্জরিত হাবিব গ্রুপের ১১ প্রতিষ্ঠান
বড় অংকের পাওনা আদায়ের জন্য চট্টগ্রাম-ভিত্তিক আলোচিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হাবিব গ্রুপের ১১টি কোম্পানির অবসায়নের আবেদন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক সংগঠন উইলমিংটন ট্রাস্ট কোম্পানি।
হাইকোর্ট গত ২৯ মার্চ সেই আবেদন গ্রহণ করেছেন বলে জানিয়েছেন আদালত সংশ্লিষ্টরা।
লিকুইডেশন বা অবসায়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিক্রি করে পাওনাদারদের ঋণ মেটানো হয়। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে পড়ে, তখন প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময় উইলমিংটন ট্রাস্ট কোম্পানির কাছ থেকে হাবিব গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন কোম্পানি রিজেন্ট এয়ারওয়েজ লিমিটেড উড়োজাহাজ ভাড়া নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভাড়ার টাকা পরিশোধ না করায় উইলমিংটন ট্রাস্টের কাছে খেলাপী হয় রিজেন্ট এয়ারওয়েজ লিমিটেড। আর হাবিব গ্রুপের বাকি ১০ কোম্পানি বিমান ভাড়া নেওয়ার সময় ছিল এর গ্যারান্টার।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, অবসায়নের জন্য পৃথক যে ১১টি আবেদন করা হয়েছে, সেগুলো হাইকোর্ট গ্রহণ করেছেন। এরপর আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির আইনজীবীরা গত ১৯ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে গ্রুপটির ১১ প্রতিষ্ঠানের নামে এই লিগ্যাল নোটিশ প্রচার করে। যেই নোটিশে, এই মামলায় কেউ প্রতিদ্বন্দীতা করতে চাইলে তাকে আদালতে হলফনামা দাখিলের আহ্বান জানানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অবসায়নের জন্য আবেদন করা এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কাস্টমস বন্ড ও অন্যান্য সংস্থার পাওনা প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকা।
তবে উইলমিংটন ট্রাস্ট হাবিব গ্রুপের কাছে কত টাকা পাওনা সেটি প্রকাশ করতে চাননি প্রতিষ্ঠানটির আইজীবীরা। পাওনার পরিমাণ অনেক বড়, শুধু এতটুকুই ধারণা দিয়েছেন তারা।
একজন কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, হাবিব গ্রুপের ১১টি কোম্পানি অবসায়নের প্রাথমিক কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু করেছেন হাইকোর্ট। এখন কেউ এই মামলায় প্রতিদ্বন্দীতা করতে চাইলে তিনি/তারা আদালতে আবেদন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, পরবর্তী নির্ধারিত দিনের মধ্যে কেউ পক্ষভুক্ত হোক আর না হোক, অবসায়নের এই আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণের কার্যক্রম শুরু করবেন আদালত। এরপর আদালত যদি মনে করেন এই কোম্পানি অবাসায়ন করে উইলমিংটন ট্রাস্ট কোম্পানির পাওনা পরিশোধ করা সম্ভব, তাহলে এই ১১টি কোম্পানি অবসায়নের জন্য হাইকোর্ট লিকুইডটর বা অবসায়ক নিয়োগ করবেন।
এরপর পরবর্তী অন্যান্য আইনগত কার্যক্রম সম্পাদন করে উইলমিংটন ট্রাস্টের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করবেন হাইকোর্ট।
তিনি বলেন, শুধু ওই বিদেশি প্রতিষ্ঠানই এই টাকা পাবে না। যদি পাওনা আদায়ে আরো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মামলা থাকে হাবিব গ্রুপের এই ১১ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, অবাসায়ন হলে তারাও সেই পাওনা পাবেন।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে হাবিব গ্রুপের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানিয়েছেন, উইলমিংটন ট্রাস্ট কোম্পানির বকেয়া বিমান ভাড়া পরিশোধ না করায় রিজেন্ট এয়ারওয়েজসহ গ্রুপের আরও ১০ কোম্পানি অবসায়নের জন্য আবেদন করেছে।
অবসায়ন হতে যাচ্ছে যে ১১ কোম্পানির
হাইকোর্ট সূত্রে জানা যায়, অবসায়নের জন্য আবেদন করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- হাবিব স্টিলস লিমিটেড, ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেড, লিগ্যাসি ফ্যাশন লিমিটেড, রিজেন্ট স্পিনিং মিলস লিমিটেড, রিজেন্ট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড, সিয়াম সুপেরিয়র লিমিটেড, এইচ জি এভিয়েশন, এমটিএস রি রোলিং মিলস লিমিটেড, আনোয়ারা পেপার মিলস লিমিটেড, রিজেন্ট পাওয়ার লিমিটেড এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজ লিমিটেড।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হাবিব স্টিলস লিমিটেডে ১৪ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৭৯৭ কোটি টাকা, ডায়মন্ড সিমেন্ট লিমিটেডে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের ৪০৯ কোটি টাকা এবং রিজেন্ট স্পিনিং মিলস লিমিটেডে সাত প্রতিষ্ঠানের ৫০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
অন্যান্য কোম্পানিগুলোও বিভিন্ন ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সংস্থার কাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ঋণ রয়েছে।
যা বলছে পাওনাদাররা
এক্সিম ব্যাংকের অ্যাডিশনাল ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক এস এম আবু জাকের বলেন, হাবিব গ্রুপের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধের (ওয়েন্ডিং আপ) লিগ্যাল নোটিশ পত্রিকায় এসেছে। গ্রুপটির কাছে ব্যাংকের পাওনা থাকায় বিষয়টি লিগ্যাল সেকশনকে অবহিত করা হয়েছে।
"লিগ্যাল সেকশনের পরামর্শের ভিত্তিতে এ বিষয়ে ব্যাংক আইনগত ব্যবস্থা নেবে," উল্লেখ করেন তিনি।
ইসলামী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক আব্দুন নাসের বলেন, হাবিব গ্রুপের রিজেন্ট স্পিনিং মিলিসের কাছে আগ্রাবাদ শাখার ১০০ কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে।
"প্রতিষ্ঠানটির ওয়েন্ডিং আপ ঘোষণার লিগ্যাল নোটিশ নজরে আসার পর আমরা প্রধান কার্যালয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। প্রধান কার্যালয়ের পরামর্শের ভিত্তিতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে," যোগ করেন তিনি।
সরকারের কাছেও বিপুল পরিমাণ বকেয়া
ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও গ্রুপটির তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, চট্টগ্রামের ২৭৭ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্ক ফাঁকির দায়ে জরিমানাসহ এই অর্থ পাওনা রয়েছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের।
এরমধ্যে ওয়েন্ডিং আপের জন্য আবেদন করা প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট স্পিনিংয়ের কাছে ২০০ কোটি টাকা, সিয়াম সুপেরিয়রের কাছে ৭৬ কোটি টাকা এবং রিজেন্ট টেক্সটাইলের কাছে ২৭ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।
এছাড়া, প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ৩০০ কোটি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রায় ২০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে বলে জানা গেছে।
পাওনাদারদের বিপদে ফেলে দেশ ছেড়েছেন পরিচালকরা
এদিকে, প্রায় ৩০ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা বকেয়া রেখে হাবিব গ্রুপের পাঁচ কর্ণধার দেশত্যাগ করেছেন। দেশত্যাগ করা পাঁচ কর্ণধার হলেন- হাবিব গ্রুপের চেয়ারম্যান ইয়াকুব আলী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াসীন আলী, পরিচালক মাশরুফ হাবিব, সালমান হাবিব ও তানভীর হাবিব।
আইডিএলসি ফাইন্যান্সের একটি মামলায় গত ১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও তারা দেশ ছেড়েছেন বলে টিবিএসকে নিশ্চিত করেছে আদালত ও ইমিগ্রেশন পুলিশ।
ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের পতন
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রামের হাবিব উল্লাহ মিয়া হাবিব ট্রেডিং নামে ভোগ্যপণ্য আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে হাবিবের হাত ধরে তার তিন সন্তান ইয়াকুব আলী, মাহবুব আলী ও ইয়াসিন আলী ব্যবসায় আসেন।
গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, জাহাজ ভাঙ্গা, ইস্পাত, সিমেন্ট ও কাগজ শিল্পে ব্যবসা সম্প্রসারণের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন হাবিব গ্রুপ। সাত দশক সুনামের সঙ্গে ব্যবসাও করেন তারা।
তবে গত এক দশকে সার, বিদ্যুৎ উৎপাদন, এভিয়েশন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণই লোকসানের পথে নামায় গ্রুপটিকে। গ্রুপটির ৩১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশিরভাগেরই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু প্রতিষ্ঠান অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, ১৯৪৭ সালে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরুর পর কালপরিক্রমায় এক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে হাবিব গ্রুপ।
তবে ২০১৯ সাল থেকেই গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানি ঋণ খেলাপি করতে থাকে।
গ্রুপটির ৩১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালু আছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে এক সময় ১৬ হাজারের বেশি লোক কাজ করতো, যা এখন নেমে এসেছে হাজারের নিচে।
গ্রুপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংক-প্রতিষ্ঠানের মামলা
গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে অর্থঋণ মামলা দায়ের করেছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ১৫০ কোটি টাকা ঋণ আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় ব্যাংকটির জুবলী রোড শাখা এই মামলা দায়ের করে।
ন্যাশনাল ব্যাংক ছাড়াও গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে বেসিক ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, আইডিএলসি ও ব্যাংক এশিয়া অর্থঋণ মামলা দায়ের করে। এছাড়া, ওয়ান ব্যাংকের ১৫টিসহ কমপক্ষে ২৫টি চেক প্রত্যাখানের (এনআই অ্যাক্ট) মামলা হয়েছে গ্রুপটির পরিচালকদের বিরুদ্ধে।
হাবিব গ্রুপের বিরুদ্ধে তিন ব্যাংকের হয়ে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাঈম ভুইয়া বলেন, কোনো কোম্পানি ওয়েন্ডিং আপ করতে গেলে তার সংশ্লিষ্ট পাওনাদাররা আদালতের দারস্থ হবেন। পাওনাদারদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানির সম্পত্তি ও দেনা-পাওনা সমন্বয় করে আদালত ওয়েন্ডিং আপের সিদ্ধান্ত দেবেন।