রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: অবশেষে তৈরি চীনা রেসিপি?
২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে চীনের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক সাহসী পূর্বাভাস দেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশে বসবাসরত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ২০২৩ সালে শুরু হবে।
গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে এ কথা বলেছিলেন চীনের রাষ্ট্রদূত।
সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গারা যখন সামরিক নির্যাতনের হাত বাঁচতে মিয়ানমার থেকে পালাতে শুরু করে তখন মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের নাগরিকদের এখন দেশে ফেরার সময় হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের কয়েক মাস আগেও একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেছিলেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে লোটে প্যালেস নিউইয়র্ক হোটেলে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং জাতীয় আদালতের বিচারকার্যের সময় এগিয়ে আসতে বলেন। পাশাপাশি মিয়ানমারের মানবাধিকারের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াইকে শক্তিশালী করতে ও আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করতে আইসিজেতে গাম্বিয়াকে সমর্থন দেওয়ার আহ্বানও জানান।
এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আর্থিক ব্যয়ের প্রতিও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গার জন্য বছরে ১.২২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার বলেছে, বলপূর্বক পুনর্বাসন কোনো উপায় হতে পারে না। প্রত্যাবাসন হতে হবে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ।
তবে চীন ও রাশিয়া বরাবরই যেকোনো ধরনের বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে ছিল।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যখন মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান বন্ধ করতে মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়েছে এবং জাতিসংঘের বিশেষ দূত নিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে, তখন অন্যান্য আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে এই দেশ দুটিও এর বিরোধিতা করেছে।
২০১৭ সাল থেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিল, কিন্তু বলতে গেলে কোনো অগ্রগতিই হয়নি।
এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশের জন্য পৃথক সমস্যা নয়। এ সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে ভারত, মালয়েশিয়া এমনকি সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশেও।
প্রত্যাবাসনকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য মিয়ানমারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে চীনা রাষ্ট্রদূতের বলা কথাগুলোর ফলে বেশ কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বিগ ব্রাদার
ঐতিহাসিকভাবেই চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। তাই মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল নিয়ে নিন্দা প্রস্তাব পাশ করার বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে চীন স্বাভাবিকভাবেই মিয়ানমারকে সমর্থন দেয়।
মিয়ানমারের সঙ্গে শক্তিশালী মিত্রতা গড়ে তুলছে চীনা। এই দেশটিকে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের প্রভাব নিশ্চিত করার চাবিকাঠি মনে করে।
এর আগে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার অভিযোগে দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পদক্ষেপ আটকে দিয়েছিল চীন।
এমনকি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যখন বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠছিল, তখনও বেইজিং একে মিয়ানমারের 'অভ্যন্তরীণ সমস্যা' হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
চীন বারবার মিয়ানমারের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। নিষেধাজ্ঞা ও বলপ্রয়োগের না করে চীন তার নিজস্ব রেসিপি প্রস্তাব করেছে: ঢাকা ও নেইপিদোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা।
এমন রেসিপি যে চীন এবারই প্রথম হাজির করেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। সহিংসতার হাত থেকে বাঁচতে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের জন্য ২০১৭ সালের নভেম্বরে এক প্রাথমিক চুক্তি সই করেছিল মিয়ানমার ও বাংলাদেশ।
কিন্তু এ চুক্তি কোনো কাজেই আসেনি।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উদ্যোগটি শক্তিশালী পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু চীন তার নিজস্ব কৌশলকে দুর্বল করে ফেলে এমন যেকোনো উদ্যোগ আটকে দিতে তৈরিই ছিল।
২০১৭ সালের অক্টোবরে ঢাকায় সাবেক চীনা রাষ্ট্রদূত আশা প্রকাশ করেছিলেন, শিগগিরই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে। তিনি এ-ও বলেছিলেন, 'আমরা আশা করি আমাদের দুই ভাই বসে এই সমস্যার সমাধান করবে। আলোচনার ক্ষেত্রে কিছু দৃশ্যমান অগ্রগতি হতে দেখেছি আমি।'
একই বছরের এপ্রিলে ঢাকা সফরকালে চীনের বিশেষ দূত সান গুয়োশিয়াং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিকভাবে করার আহ্বান করেন। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে সহায়তা করতে প্রস্তুত বেইজিং। বাংলাদেশ যেন বিষয়টিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে না যায়, তার আহ্বানও করেন গুয়োশিয়াং।
এর ছয় মাস পরে বিশেষ দূত আবারও একই বার্তা নিয়ে ঢাকা ভ্রমণ করেন।
এরই মাঝে মিয়ানমারে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা চালিয়ে যায় চীন।
রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নির্মূলের অভিযোগ থাকলেও চীনের নীতির কারণে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ওপর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।
মিয়ানমারে সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় আসার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ আরও ফিকে হয়ে যায়।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাসনক্ষমতার বদলের ঘটনাকে প্রত্যাবাসনের জন্য নতুন উদ্বেগ বলে অভিহিত করেন।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি পরিবর্তনের কিছু আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
নতুন উদ্যম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের পরও আরও কিছু উপায় হাতে ছিল।
এ বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও আসিয়ানভুক্ত আটটি দেশের রাষ্ট্রদূত বা কনস্যুল জেনারেলদের জন্য রাখাইনে এক সফরের আয়োজন করে মিয়ানমার।
ওই দলটি টেকনাফের বিপরীতে অবস্থিত নাখুয়া রিসেপশন সেন্টার ও নিকটবর্তী একটি গ্রাম, এবং সিত্বে ও চাকতো অঞ্চলের দুইটি অভ্যন্তরীণ ডিসপ্লেসমেন্ট ক্যাম্প পরিদর্শন করে।
তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বর্তমানে স্থিতিশীল এবং প্রত্যাবাসনের পক্ষে অনুকূল।
ভারত, চীন ও অন্যান্য আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোও সমস্যা সমাধানে একটি মতৈক্যে পৌঁছায়।
বর্ষার আগে একটি পাইলট প্রকল্পের কথাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ধীরেসুস্থে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে এবং কোনো সংকটের উদ্ভব ঘটলে তার সমাধান করা হবে।
ওই সফরের কয়েক দিন পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের নতুন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন আশা প্রকাশ করেছেন চীনের সংকট সমাধানের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টার মাঝেই শীঘ্রই প্রথম ধাপে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে।
এর মাসখানেক পর গতকাল পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন কুনমিংয়ে চীন ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেন।
এ বৈঠকের কথা বাইরে প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকের এজেন্ডা ছিল বর্ষার আগে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা।
বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। কিন্তু একটি সূত্র অনুযায়ী, পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করার আগে ১,০০০ রোহিঙ্গাকে রাখাইন রাজ্যে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনার জন্য ওই বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
আজ ২০ জন রোহিঙ্গা ও সাত বাংলাদেশি কর্মকর্তার একটি দল পরিস্থিতির সার্বিক মূল্যায়নের জন্য রাখাইন রাজ্যে গিয়েছেন।
এ সফরই ঠিক করবে কখন ও কীভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে। কয়েক বছর ধরে থমকে থাকার পর আলোচনার এ হঠাৎ তোড়জোড়ের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আবারও আলোর মুখ দেখছে।