নির্বাচনের বছরের বাজেট: সহজ হবে না রাজনীতি আর অর্থনীতির হিসাব মেলানো
পহেলা জুনের বিকেলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যখন বহুতল সংসদভবনের আলোকোজ্জ্বল সভাকক্ষে দাঁড়িয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন, সেখানে বিএনপির কোনো সংসদ সদস্যের উপস্থিতি দেখবেন না তিনি।
গত ডিসেম্বরে বিএনপির সাত সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেছিলেন। ৩৫০ আইনপ্রণেতার এ সংসদে তাদের অনুপস্থিতি হয়তো বড় কোনো প্রভাবক হয়ে দাঁড়াবে না, নিদেনপক্ষে সংখ্যার হিসেবে তো নয়ই। আদতে, বিএনপির সংসদ সদস্যরা ছেড়ে যাওয়ার পর ওসব শূন্য আসন পূরণ করে ফেলেছেন নতুন সদস্যরা।
কিন্তু বিএনপির সাম্প্রতিক বিক্ষোভ সমাবেশ ও আগামী মাসগুলোর জন্য পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড এটাই নির্দেশ করে যে, অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনার সংসদীয় আবহের কোনো অস্তিত্ব সংসদের বাইরে নেই।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহসা উত্তাল হয়ে উঠেছে। সহিংসতার ভয় দেখিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি উভয় দলই রাজপথে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারে ব্যস্ত। নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে বিতর্কের কোনো সমাধানের দেখা নেই — আওয়ামী লীগ এমন সরকার গঠনের দাবি সবসময় প্রত্যাখ্যান করেছে, অন্যদিকে বিএনপি প্রয়োজনে বলপ্রয়োগে ক্ষমতাসীন দলকে সরিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথ সুগম করতে বদ্ধপরিকর। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এখন মনে করছেন, সম্প্রতি গাজীপুরের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবি এবং নতুন মার্কিন ভিসানীতি সামনের দিনগুলোতে দেশের রাজনীতির ভোল পালটে দিতে সহায়তা করতে পারে।
এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুর দিকে হতে যাওয়া নির্বাচনের আগের মাসগুলো আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র নতুন করে যাত্রার পর থেকে অনেকবারই নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট উত্তাল হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগেও এমন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাব পড়বে অর্থনীতি ও মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর।
সংসদে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট প্রস্তাব পাস করানোর ক্ষেত্রে হয়তো কোনো কঠিন পর্যালোচনা বা শক্ত বিরোধিতার মুখে পড়বেন না। কিন্তু নতুন বাজেটের প্রয়োগ প্রক্রিয়ায় আঁচ ফেলবে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ অস্থিরতার মাত্রা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাজপথে তার প্রতিফলনের ওপর। এটা প্রায় নিশ্চিত যে, প্রবৃদ্ধির গতিকে ধরে রাখতে নতুন বাজেটের প্রথম ছয় মাস বেশ বেগ পেতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। এরপর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পরের ছয়মাসের নিয়তি বড় অংশে নির্ভর করবে প্রথম ছয় মাসের প্রকৃতির ওপর। আগামী জুলাই-পরবর্তী ছয়মাসের পরিস্থিতি নিয়ে সঠিকভাবে কোনো অনুমান করা বেশ কঠিন।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে করোনা মহামারির আগের হারে নিয়ে যাওয়া একটা কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু গত বছর ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর এ কাজটা আরও বেশি কঠিন ও জটিল হয়ে উঠেছে।
ডিসেম্বরে দল সংসদ নির্বাচনে জয়ের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তুলে নেওয়ার সময় দেশের অর্থনীতি দুর্দান্ত পর্যায়ে ছিল — তার আগের কয়েক বছর গড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল অর্থনীতির। এক পর্যায়ে প্রবৃদ্ধি বেড়ে রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশও হয়।
প্রবৃদ্ধির দ্রুতগতির ওপর ভরসা করে অর্থমন্ত্রী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য তার প্রথম বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮.৫ শতাংশ স্থির করেন। কিন্তু সব হিসাব বদলে দিয়ে অর্থনীতির ওপর আচমকা আঘাত হয়ে আসে করোনাভাইরাস মহামারি। ২০২০ সালে মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনা ধরা পড়ে এবং করোনা মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ক্রমেই দেশের সব ধরনের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এমনকি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম দিনও দেশ লকডাউনে ছিল। কোভিডের কারণে দারিদ্র্য দূরীকরণে ও শিক্ষাখাতে দেশের বিভিন্ন অর্জনও বিপরীতমুখী হয়ে পড়ে। উড়ন্ত অর্থনীতি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যায়।
মহামারির ধাক্কা থেকে কাটিয়ে ওঠার মাঝেই নতুন করে আঘাত হানে রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণ। এ যুদ্ধ কেবল বিশ্ব অর্থনীতিকেই টালমাটাল করেনি, সেই সঙ্গে অর্থমন্ত্রী ও তার সরকারের জন্যও পরিস্থিতিকে কঠিন করে তুলেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ, ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ, ও ভর্তুকির বোঝার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি ইত্যাদির কারণে সরকার বাধ্য হয়ে আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়।
নির্বাচনের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা ইতোমধ্যে চাপের মুখে থাকা অর্থনীতিকে আরও বেশি চাপে ফেলবে। মুদ্রাস্ফীতির চাপে থাকা জনগণকে একটু চাপমুক্ত করতে কোনো রাজস্ব ব্যবস্থা এখনো দিতে পারেননি অর্থমন্ত্রী।
অর্থনৈতিক এ মন্দার সময়, রাজস্ব প্রশাসনও লক্ষ্যমাত্রা ও সংগৃহীত রাজস্বের মধ্যকার পার্থক্য কমাতে বেগ পাচ্ছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানো ও প্রশাসনিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে রাজস্ব অতি গুরুত্বপূর্ণ সরকারের জন্য। নির্বাচনের বছর হলেও অর্থমন্ত্রী আরও রাজস্ব অর্জনের জন্য করজালের পরিধি বাড়াতে পারেন। গণমাধ্যমে আসা অনেক কর প্রস্তাব থেকে রাজস্বের জন্য মাতম স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের বিরোধী হলে অথবা সংকট কাটাতে প্রস্তাবিত ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্কের দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হলে অর্থমন্ত্রী তার কিছু প্রস্তাবের জন্য সমালোচিত হতে পারেন। ২০২৪-এর জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচন জিততে চায় অর্থমন্ত্রীর দল, কিন্তু তার বাজেটে নির্বাচনের আবহ দেখতে বেগ পেতে হতে পারে সমালোচকদের। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ভোটারদের একটা বড় অংশকে খুশি করার মতো বাজেট নিয়ে আসা সম্ভব নাও হতে পারে।
কিন্তু অর্থমন্ত্রীর বাজেটকে অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ঝড়ও মোকাবিলা করতে হতে পারে। বলা বাহুল্য, দেশের অর্থনীতির জন্য এখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় বিনিয়োগ, আর যেকোনো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাই বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
অনেক বাধা সত্ত্বেও রাজনৈতিক সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান অর্থনীতির গেমচেঞ্জার হিসেবে আবির্ভাব হতে পারে। এর জন্য এ চরম সংকটকালে দারুণ কিছু ব্যবস্থার প্রয়োজন, যে সংকট এখন নির্বাচনের বছরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মিশ্রণে পরিণত হয়েছে। মোটের ওপর নতুন বিনিয়োগ এবং দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন একটি ভালো নির্বাচন দরকার।