সাইকেল চালিয়ে নির্বাচনী প্রচার! মেয়র পদে পেলেন ৩০ হাজার ভোট
সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাড়ার বস্তি সদৃশ আধাপাকা যে ঘরটিতে শাহজাহান মিয়া থাকেন, সেটিতে কক্ষ মাত্র দুটি। এই দুই কক্ষেই তিন সদস্যের পরিবারের রান্নাবান্না, থাকা খাওয়া সব চালাতে হয়। ঘরে আসবাব বলতে তেমন কিছু নেই। সামনের কক্ষে একটি বিছানা, জীর্ণ আলনা ও সেলাই মেশিন, আর একটি ভাঙা সোফা আছে বটে তবে সেটিতে একের অধিক লোক বসলেই গাইগুই করে ভেঙে পড়ার হুমকি দেয়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সুরমা নদী লাগোয়া নগরের ঘাসিটুলা মজুমদার পাড়া এলাকার এই বাসায় যখন পৌঁছাই তখন সন্ধ্যা। এর আগের দিনই একটি বিরাট চমক দেখিয়েছেন শাহজাহান মিয়া, এলাকার লোকদের কাছে যিনি শাহজাহান মাস্টার নামে পরিচিত। এখন অবশ্য নগরবাসীও তাকে এই নামে চেনেন।
বুধবার (২১ জুন) অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছেন তিনি। ৮ প্রার্থীর মধ্যে ৩য় হয়েছেন শাহজাহান মিয়া।
কোন ব্যানার, পোস্টার নেই, মাইকিং, মিছিল, সভা-শোডাউন নেই, নিজের পক্ষে একজন কর্মীও নেই। এমন একজন প্রার্থী পেয়ে গেছেন ৩০ হাজার ভোট!
তার এই বিপুল সংখ্যক ভোট প্রাপ্তি বিস্মিত করেছে সকলকে। তাই শাহজাহান মিয়াকে একনজর দেখতে ও তার সাক্ষাৎকার নিতে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তার বাসায় সাধারণ ভোটার ও গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় ছিল।
শাহজাহান যে ঘরে থাকেন, সেখানে দুই কক্ষ মিলিয়ে বৈদ্যুতিক লাইট মাত্র একটি। আর এর আলো এতোই ক্ষীণ যে সামনের লোকটির মুখও ভালো করে দেখা যায় না। শাহজাহানের আলোয়ই শুরু হয় আলাপ।
ময়মনসিংহ থেকে অভাবের তাড়নায় ২০০২ সালে সিলেট আসেন শাহজাহান। তখন তিনি নিতান্ত কিশোর। সিলেটে এসে নগরের কানিশাইল এলাকার একটি ছাপড়া রেস্টুরেন্টের 'গ্লাস বয়ের' চাকরি নেন তিনি। গ্লাস বয় মানে গ্লাস ধোয়ামোছার কাজ করা।
রেস্টুরেন্টে কাজ করলেও পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ ছিলো তার। তাই কাজের পাশাপাশি ভর্তি হন নগরের ভোলানন্দ নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর ময়মনসিংহ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। আর ২০১৮ সালে সিলেটের মদন মোহন কলেজ থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ হন এই অদম্য তরুণ।
এই সময়কালে সিলেটের প্রায় ৮০টির মতো রেস্টুরেন্টে কাজ করেন শাহজাহান। কাজ করেছেন মোমবাতি কারখানায়ও। এতে একটা বিরাট লাভ হয় শাহজাহানের।
তিনি বলেন, "অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট ও কারখানায় কাজ করার ফলে শ্রমিক শ্রেণির সাথে আমার ভালো পরিচয় হয়। তারাও আমাকে পছন্দ করেন। এই নির্বাচনে তারা আমাকে বিরাট সহায়তা করেছেন।"
মেয়র পদে ৮ প্রার্থীর মধ্যে অর্থে ও 'সামাজিক মার্যাদায়' সবচেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ব্যতিক্রমী প্রচারের কারণে নজর কাড়েন তিনি।
সকালেই নিজের বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন শাহজাহান। একা একা সাইকেল নিয়েই চষে বেড়াতেন নগর। যেতেন ভোটারদের কাছে। প্রচার সামগ্রী বলতে ছিল কেবল লিফলেট; তাও অন্যের টাকায় ছাপানো। সেগুলো তুলে দিতেন ভোটারদের হাতে। ভোট ও দোয়া চাইতেন।
নিজের প্রচারণা সম্পর্কে শহজাহান মিয়া বলেন, "সকালে সাইকেল নিয়ে বের হতাম আর সন্ধ্যায় ফিরতাম। এই সময়ে যতটা সম্ভব মানুষের কাছে যেতাম। আমার চা নাস্তা বা খাওয়ার চিন্তা করতে হতো না, প্রায় সব রেস্টুরেন্টের শ্রমিকরাই পরিচিত। তারা খাওয়াতেন।"
তিনি বলেন, "টাকা পয়সা না থাকায় ব্যানার পোস্টার করতে পারিনি। লিফলেটও অন্যরা করে দিয়েছেন। নির্বাচনে আমার পকেট থেকে সবমিলিয়ে ২/৩ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে।"
এখন স্থায়ী কোন পেশা নেই তার। যখন যা পান তা করেন। বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ সাপ্লাই দিয়ে থাকেন। নিজের একটা ফার্মেসিও ছিল, তবে এখন আর নেই।
নিজেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তবু মানুষের সেবায় সবসময়ই নিবেদিত ছিলেন শাহজাহান।
কানিশাইল এলাকায় ফ্রি চিকিৎসাকেন্দ্র খুলে গরিব শ্রমজীবীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। কোচিং সেন্টার খুলে গরীব বাচ্চাদের ফ্রি পড়িয়েছেন। এমনকি করোনার সময় ২০০ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন বলে জানান শাহজাহান।
নিজের নামের সাথে মাস্টার শব্দ যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে শাহজাহান বলেন, "সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি আধা সরকারি প্রাইমারি বিদ্যলয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছি। এছাড়া কোচিং সেন্টারে ফ্রি পড়াই। তাই সবাই শাহজাহান মাস্টার ডাকে।"
প্রায় ৩০ হাজার ভোট পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "মানুষ মায়া থেকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছেন। তারা আমাকে পছন্দ করেছেন। এই ঋণ শোধ হবার নয়।"
শাহজাহান বলেন, "আমার প্রতীক মানুষ জানতো না। আমি একা মানুষ। সবার কাছে যেতে পারিনি। না হলে আরো ভোট পেতাম।"
এর আগে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনের এমপি পদে মনোনয়ন কিনেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, "সেবার মনোনয়ন জমা দেইনি। মনোনয়পত্রের সাথে এক শতাংশ ভোটারের সাক্ষর নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। কিন্ত তখন তা জোগাড় করতে পারিনি।"
তিনি বলেন, "ছোটকালে পরিকল্পনা ছিল জনপ্রতিনিধি হওয়ার। আমি ছোটবেলায় পড়ালেখার খাতা কলম কিনতে পারিনি। তাই মানুষের সেবা করার ইচ্ছা আমার সব সময়ের। এ কারণে নির্বাচনে প্রার্থী হই।"
জনসমর্থন থাকলে আগামীতেও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ রয়েছে বলে জানান শাহজাহান মিয়া।
শাহজাহানের এতো বিপুল সংখ্যক ভোট প্রাপ্তি সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, "তিনি সম্ভবত ক্ষোভের ভোট পেয়েছেন। পছন্দের প্রার্থী না পেয়ে ক্ষুব্ধ ভোটাররা তাকে ভোট দিয়ে থাকতে পারেন।"
"এছাড়া বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ভোট বর্জন করলেও তাদের অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। ফলে কাউন্সিলর পদে ভোট দিতে এসব দলের অনেকে ভোট কেন্দ্রে এসেছেন। তাদের অনেক ভোটও শাহজাহান মিয়া পেয়ে থাকতে পারেন," বলেন তিনি।