পাহাড় থেকে খামারে: গয়ালের বুনো যাত্রা
পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি বুনো গরু গয়াল। গত দেড় দশকে পাহাড়ি অঞ্চলসহ সমতলেও গয়ালের বাণিজ্যিক পালন শুরু হয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামের মেজবান, ওরশ এমনকি কোরবানিতেও প্রাণীটির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
চট্টগ্রামভিত্তিক অনলাইনে খাদ্যপণ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান নিত্যপ্রয়োজনীয় বিডি। আসন্ন কোরবানির ঈদকে ঘিরে এবার অনলাইনে গয়াল বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এরমধ্যে কোরবানি দাতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়াও মিলছে। গত এক সপ্তাহে ১৮টির বেশি গয়াল বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আরো অনেকে গয়াল কেনার আগ্রহ দেখিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় বিডির উদ্যোক্তা ইকবাল ফয়সাল জানান, "বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে অনেকে পাহাড়ি গয়াল লালনপালন করেন। এক বছর ধরে আমরা পাহাড় থেকে গয়াল কিনে প্রক্রিয়াজাত করে মাংস বিক্রি করে আসছি। এতে আমাদের বহু গ্রাহক তৈরি হয়েছে। এবার প্রথম কোরবানির জন্য গয়াল বিক্রি শুরু করেছি এবং বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি।"
"আমরা প্রতি কেজি মাংস ৫০০-৫৫০ টাকা হিসেব করে লাইভ ওয়েটে গয়াল বিক্রি করছি। কেউ কেউ ওজনে না নিয়ে আস্ত গয়াল কিনছেন", বলেন তিনি।
গত দুই বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে গয়াল লালন করছেন সাতকানিয়া উপজেলার খান এগ্রোর মালিক গিয়াস উদ্দিন খান মিন্টু। এবছর কোরবানির ঈদকে ঘিরে ৩২টি গয়াল পালন করেছেন এই খামারি। ইতোমধ্যে ২৭টি গয়াল বিক্রি হয়েছে তার।
গিয়াস উদ্দিন খান টিবিএসকে বলেন, "গয়াল পালন বেশ লাভজনক। কারণ গয়ালকে বাড়তি কোনো খাবার দিতে হয় না। পাহাড়ের মধ্যে আমার খামার। উন্মুক্ত পাহাড়ে গয়ালগুলো সারাদিন চড়ে বেড়ায়। সন্ধ্যায় খামারে ফিরে আসে। প্রায় প্রতিটি গয়াল বিক্রি করেছি তিন থেকে চার লাখ টাকার মধ্যে। যেগুলো একবছর আগে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে এক-দেড় লাখ টাকায় কিনতে হয়েছে।"
গিয়াস উদ্দিন আরো বলেন, "এখন চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে খামারে গয়াল লালন-পালন হচ্ছে। পাহাড় থেকে আনার পর এসব গয়ালের পোষ মানাতে বেশ সময় লাগে। তবে আস্তে আস্তে অন্য পোষা গয়াল ও গরুগুলোর সঙ্গে মিশে সেগুলো শান্ত হয়ে ওঠে।"
এবারই প্রথম কোরবানির জন্য গয়াল কিনেছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী জুনায়েদুল হক। তিনি বলেন, "স্বাস্থ্যগত বিষয় চিন্তা করে চর্বি এড়াতে আমি দীর্ঘদিন ধরে মহিষ দিয়ে কোরবানি করে আসছি। প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে লালন-পালন হওয়ায় এবার কোরবানির জন্য গয়াল কিনেছি।"
তবে গরু-মহিষের চেয়ে গয়ালের দাম একটু বেশি বলে জানিয়েছেন এই ক্রেতা।
ধারণা করা হয়, দেড় দশক আগে থেকে সমতলে গয়ালের বাণিজ্যিক পালনের সূত্রপাত। যদিও পাহাড়ি গ্রামগুলোর বাসিন্দারা বহুদিন আগে থেকেই বন থেকে এই গরু ধরে পালন করতেন। পাহাড়িদের কাছে এই প্রাণীটির মাংসের বেশ কদর রয়েছে।
খামারিদের তথ্যমতে, ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের সমতলে প্রথম গয়াল পালন শুরু করে রাঙ্গুনিয়ার সুখবিলাস খামার। খামারের মালিক এরশাদ মাহমুদ বলছিলেন, "২০০৭ সালে পাহাড়ি গ্রাম থেকে তিনটা গয়াল আমার খামারে নিয়ে এসে পালন করতে শুরু করি। এরপর সেগুলোর বাচ্চা হয়েছে। পরে আরও গয়াল সংগ্রহ করেছি। এখন তো প্রতিবছর ১৫০-২০০ গয়াল বিক্রি করি খামার থেকে।"
মূলত শখের বশে পাহাড় থেকে গয়াল এনে পালন শুরু করলেও এখন এটা বাণিজ্যের অংশ। একই সাথে প্রায় বিলুপ্ত প্রাণিটির প্রজননও বাড়ছে দেশে। তিনি জানান, তার কাছ থেকে প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন খামারীরা গয়াল নিয়ে লালনপালন করছেন।
গয়াল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পার্বত্য এলাকার গভীরে বিভিন্ন পাড়ায় একেকজন বাসিন্দা পাঁচ-সাতটা করে গয়াল পালন করেন। এগুলো সেখানে মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়। তবে কে কোনটার মালিক, তার চিহ্ন দেয়া থাকে। মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়ানোর কারণে এগুলোর বুনো স্বভাব থেকে যায়, পুরোপুরি গৃহপালিত হয় না।
বিক্রির উপযোগী হলে লবণের ফাঁদ দিয়ে গয়াল ধরে বিক্রি করা হয়। ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন ধরে নানা পাহাড় ডিঙিয়ে জনপদে নিয়ে এসে গয়াল বিক্রি করেন।
নাম গয়াল হলেও প্রাণীটি পাহাড়ি গরু বা বন গরু হিসাবে হিসাবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত। অনেকে 'চিটাগাং বাইসন' বলেও ডাকেন গয়ালকে।
বাংলাদেশের পার্বত্য বনাঞ্চলের গহীন অরণ্যে প্রাণীটির আদি নিবাস।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) দীপান্বিতা ভট্টাচার্য বলেন, "১৯৬৪ সাল থেকে গয়ালকে বুনো প্রাণীর তালিকা থেকে সরিয়ে গবাদিপশু হিসাবে গণ্য করা হয়। এর আগ পর্য়ন্ত গয়াল ছিল বন্য প্রাণীর তালিকাভুক্ত একটি প্রাণী। তবে এর আগে থেকেই পাহাড়ি বাসিন্দারা মাংসের জন্য গয়াল শিকার করতেন। অনেক গ্রামের বাসিন্দারা গয়াল ধরে লালনপালনও করতেন। প্রায় বিলুপ্ত প্রাণী হলেও বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে দুটি বাছুরসহ ১৫টি বুনো গয়ালি রয়েছে। এছাড়া দেশের বনে এখনো অন্তত ২৫টি বুনো গয়াল রয়েছে।"
তিনি জানান, গয়ালের পরিবেশ ও খাবার নষ্ট, ফাঁদ পেতে অবৈধ শিকারের কারণে বাংলাদেশের বন থেকে এই প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এখনো বনে যেসব বুনো গয়াল রয়েছে, সেগুলো রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছেন তারা।
অনেকটা গরুর মতো দেখতে হলেও সাধারণ সমতলের গরু বা মহিষের সঙ্গে গয়ালের অনেক পার্থক্য রয়েছে। সবচেয়ে বড় পার্থক্য এই প্রাণীটি আকারে অনেক বড় হয়, মাংসের পরিমাণ অনেক হয়। তবে গয়াল থেকে দুধ দোয়ানো যায় না। প্রাপ্তবয়স্ক একটি গয়ালের ওজন হয় ৪০০ থেকে ৮০০-৯০০ কেজি পর্যন্ত।
গঠনের দিক থেকে শিং গোড়া থেকে অনেক মোটা, লম্বা হয়। পিওর ব্রিড গয়ালের পুরো শরীর কালো বা বাদামি হলেও পায়ের নিচের অংশে সাদা দাগ থাকে।
গয়ালের প্রজননে ১০ থেকে ১১ মাস লাগে। একেকটি গয়াল ১৫ থেকে ১৬ বছর বাঁচে। ঘাস, পাতা, খড় ইত্যাদি খেয়ে থাকে।