বিএনপি বলছে লক্ষ্মীপুরে নিহত যুবক কৃষক দলের কর্মী, আ. লীগের দাবি পথচারী, সংঘর্ষে মৃত্যু হয়নি দাবি পুলিশের
কয়েকদিন পর বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল ছেলেটির। কিন্তু, লক্ষ্মীপুরে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি ঘিরে সংঘর্ষের সময়ই প্রাণ হারাতে হলো তরতাজা যুবক মো. সজীবকে। দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হয়।
এনিয়ে বিএনপির অভিযোগ, ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, নিহত সজীব বিএনপির পদযাত্রায় এসে মারা যাননি। ব্যক্তিগত কাজে এসে দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে।
আর আওয়ামী লীগ বলেছে সজীব ছিল একজন পথচারী। এ হত্যার সাথে আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত নন।
তবে ঘটনার পরপরই বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে দলীয় কর্মী বলা হয়েছে। আবার ঘটনার পর নিহত সজীবের পকেটে কৃষক দলের একটি ব্যাজ এবং ক্যাপ পেয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা। পরিবারের পক্ষ থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে, সজীব বিএনপির পদযাত্রায় অংশ নিতে জেলা শহরে যায়।
বুধবার (১৯ জুলাই) দুপুরের দিকে সজীবের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। পরে হাসপাতাল থেকে মরদেহ বুঝে নেয় পুলিশ। সেখান থেকেই তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আনোয়ার হোসেন বলেন, বেলা ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে সজীবের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। তার বাম হাতের বাহুতে দুটি জখম আছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।
বুধবার (১৯ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিএনপির পক্ষ থেকে লক্ষ্মীপুর শহরের গো-হাটা সড়কের জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানির বাসভবনের সামনে সজীবের নামাজে জানাজার আয়োজন করা হয়। সেখানে সজীবের মরদেহ-ও আনতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু, পুলিশ সজীবের মরদেহ দেয়নি বলে অভিযোগ করেন জেলা বিএনপির নেতারা।
কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, "সজীব আমাদের কৃষক দলের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। তার দাদা হানিফ মিয়া ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। সে বাড়ি থেকে পরিবারকে জানিয়ে বিএনপির পদযাত্রায় এসেছে। এখানে এসে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে তাকে খুন হতে হলো। কিন্তু, এসপি সাহেব তড়িঘড়ি করে একটি প্রেস বিফ্রিং করে বলেছেন- সজীব নাকি আমাদের কর্মী না। তাতে আমাদের বুঝতে বাকি নেই, এ ঘটনার সঙ্গে কতিপয় পুলিশ সদস্যও জড়িত ছিল। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের নামে নাকি পুলিশ মামলা করবে। যতগুলো মামলা করা হোক, কোনো মামলা দিয়ে আমাদের দমানো যাবে না। আওয়ামী লীগ রক্তের হোলিখেলা খেলছে। তারা আমাদের আন্দোলনকে রক্তাক্ত করেছে। এ সরকারকে বিদায় নিতেই হবে।"
তিনি বলেন, যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, প্রত্যেককে আমরা চিহ্নিত করেছি। প্রত্যেকের বিচার করা হবে।
সজীবের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধন্যপুর গ্রামের কফিল মেম্বার বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সজীবকে হারিয়ে তার মা নাজমা বেগম ও বোন কাজল আক্তার আহাজারি করছেন। বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন বাবা আবু তাহের।
বাবা আবু তাহের জানান, তিন ছেলের মধ্যে সজীব পেশায় টাইলস মিস্ত্রি ছিল। সে তার মেজো ভাই সুজনের সঙ্গে কাজ করত। বড় ছেলে মিজান সৌদি আরব প্রবাসী। কয়েকদিন পর সজীবেরও সৌদি যাওয়ার কথা ছিল।
বাবা আবু তাহের বলেন, মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) যখন বিএনপির পদযাত্রায় যাওয়ার সময় সে আমাকে বলে যায়, বাবা আমি একটু লক্ষ্মীপুর থেকে আসি। সন্ত্রাসীরা আমার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করছে।
চরশাহী ইউনিয়ন বিএনপি সাধারণ সম্পাদক সাফায়ত হোসেন স্বপন বলেন, সজীব আমাদের দলের একজন সক্রিয় কর্মী। তার বাড়ি চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নে হলেও তিনি সব সময় চরশাহী ইউনিয়ন বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে মিছিল-মিটিংয়ে যেতেন।
কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি মঙ্গলবার রাতে তার বাসভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে এ হত্যার ঘটনায় লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দায়ী করেছেন। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে বুধবার (১৯ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মঙ্গলবারের ঘটনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ বলেন, "সজীব সংঘর্ষে মারা যাননি। বিএনপি নেতাকর্মীরা যে স্থানে পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছে, সজীবের মৃত্যু সেখান থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে। তার মৃত্যুর পর ৯৯৯- নম্বরে একটি কল আসে। সেদিন পুলিশ বিএনপির নৈরাজ্য ঠেকাতে ব্যস্ত ছিল। পরে সেখানে পুলিশ গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়।"
এসপি বলেন, চিকিৎসকের দেওয়া তথ্যমতে, তার বাম হাতে দুটি কোপের দাগ ছিল। রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। ব্যক্তিগত কাজে সজীব শহরে এসে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে মারা যান।
মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) রাতে লক্ষ্মীপুরের গোডাউনরোড এলাকার নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে কৃষকদল নেতা সজিব হোসেন নিহতের ঘটনায় বিএনপি দেশব্যাপী কর্মসূচির দেবে বলে জানিয়েছেন দলের প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি।
বুধবার লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হাছিবুর রহমান জানায়, বিএনপির সহযোগী সংগঠন কৃষক দলের কর্মী মো। সজিব হত্যার ঘটনায় বৃহস্পতিবার জেলা বিএনপি কালোব্যাচ ধারণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এবং বিকেলে কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির বাসভবনে প্রতিবাদ সভা করবে। তিনি আরো জানান, জাতীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সজীব হত্যার শিকার হয়েছে। এখন জাতীয়ভাবে যে নির্দেশনা আসবে- জেলা বিএনপি সেটা পালন করবে।
অন্যদিকে সংঘটিত ঘটনায় মামলা মোকদ্দমা হলে কি করবে ? এমন বিষয় জানতে চাইলে তিনি জানান, বিএনপির বিরুদ্ধে মামলা তো সব সময়ই হয়।
একই দিন বিকেলে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন তার বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে জানিয়েছেন, নিহত সজীব একজন সাধারণ পথচারী ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচির স্থানে ছিলেন না এবং রাজনৈতিক কর্মীও নন। এ ঘটনায় আ. লীগের কেউ জড়িত না।
স্থানীয়দের বরাতে জানা গেছে, মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) বিকেলে বিএনপির পদযাত্রা চলাকালে শহরের সামাদ মোড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এসময় সজীবকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়। তিনি দৌড়ে কলেজ সড়কের মদিনউল্যা হাউজিংয়ের পাশের ফিরোজা টাওয়ারের একটি ভবনে আশ্রয় নেন। সেখানে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে শহরের রামগতি সড়কের আধুনিক হাসপাতালের সামনে, ঝুমুর সিনেমা হল, মটকা মসজিদ এলাকায় সংঘর্ষ হয়। এতে পুলিশসহ শতাধিক লোক আহত হন।