১৬ বছরে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস চক্র: সিআইডি
মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে জড়িত সাত চিকিৎসক সহ ১২ জনের একটি চক্র অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
রোববার (১৩ আগস্ট) রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির সদর দপ্তরের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী।
তিনি বলেন, চক্রটি ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত শতশত মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন সরবরাহ করেছে। এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করেছে।
এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- ডাক্তার ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান (৫০), ডাক্তার সোহেলী জামান (৪০), ডাক্তার মোহাম্মদ আবু রায়হান, ডাক্তার জেডএম সালেহীন শোভন (৪৮), ডাক্তার মোঃ জোবায়দুর রহমান জনি (৩৮), ডাক্তার জিল্লুর হাসান রনি (৩৭), ডাক্তার ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২), জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮), রওশন আলী হিমু (৪৫), আখতারুজ্জামান তুষার (৪৩), জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পি (৪৫) ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩)।
ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে এ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডির সাইবার টিম। গ্রেপ্তারকৃত ১২ জনের মধ্যে ৭ জনই চিকিৎসক। এদের প্রায় সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার, নয়তো প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নফাঁস করতেন।
এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৯টি মোবাইল ফোন, ৪টি ল্যাপটপ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ব্যাংক কার্ড, ভর্তির এডমিট কার্ড, নগদ দুই লাখ ১১ হাজার, থাইল্যান্ডের মুদ্রা ১৫ হাজার ১০০ বাথ উদ্ধার করা হয়েছে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, দেশের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে নিয়মিত প্রশ্নফাঁসকারী বিশাল এক সিন্ডিকেটের খোঁজ পায় সিআইডির সাইবার পুলিশ।
এ ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, চক্রটির অন্তত ৮০ সদস্য প্রায় ১৬ বছর ধরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে ফাঁস করা প্রশ্ন দিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ৮ জন তাদের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এতে শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম উঠে এসেছে, যারা প্রশ্ন পেয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকে পাশ করে ডাক্তারও হয়ে গেছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।
গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের দেওয়া বিপুল পরিমাণ ব্যাংকের চেক এবং এডমিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে, যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এছাড়াও 'মাস্টারমাইন্ড' জসীম উদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে একটি গোপন ডায়রী উদ্ধার করা হয়, যেখানে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা তার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের নাম রয়েছে। সেসব সদস্যদের ধরতে সিআইডির অভিযান অব্যহত রয়েছে।
তদন্তে উঠে এসেছে, ২০০১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার এই চক্র মেডিকেলের প্রশ্নফাঁস করেছে। এদের ব্যাংক একাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো মানিলন্ডারিং মামলায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সিআইডি জানায়, মেডিকো, ওমেকা, প্রাইমেট, ই হক এবং ইউনিভার্সাল কোচিং-এর মতো অন্তত পাঁচটি মেডিকেল কোচিং সেন্টারের সাথে চক্রের সংশ্লিষ্টতা আছে।
সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার ডাক্তার ময়েজ উদ্দিন প্রশ্নফাঁস চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে 'ফেইম' নামের একটি কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান তিনি। গত ২০ বছর এভাবে শতশত শিক্ষার্থীকে ভর্তি করিয়েছেন। ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা ময়েজ বর্তমানে জামায়াতের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে দুটি মানিলন্ডারিং মামলা রয়েছে।
এছাড়া বর্তমানে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও সাবেক ছাত্রদলের রাজনীতি করা গ্রেপ্তার অন্য চিকিৎসকরা হলেন- সালেহীন শোভন, জোবাইদুর রহমান, জিল্লুর হাসান রনি ও জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী। তারা সবাই ২০০৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। এরপর বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের আড়ালে প্রশ্ন ফাঁস করে আসছিলেন।