বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নেতাদের জন্য 'আন্তর্জাতিক পুরস্কারের' এক মায়াবী জগত!
'অ্যাচিভমেন্টস ফোরাম' নামে একটি সংস্থা থেকে ই-মেইল আসে ইয়াং লেবেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাহউদ্দিন মাহমুদের কাছে। এতে লেখা হয়, আপনি 'ম্যানেজার অব দ্য ইয়ার অ্যান্ড বেস্ট এন্টারপ্রাইজ' পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং ইয়াং লেবেলস লিমিটেড 'বেস্ট এন্টারপ্রাইজ' পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে।
ই-মেইলটিতে আরো বলা হয়, কোম্পানির সাফল্যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রধান নির্বাহী, মালিক এবং শীর্ষ-স্তরের পরিচালকদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় এই পুরস্কারে।
একটি বার্ষিক 'আন্তর্জাতিক' অনুষ্ঠানে তাকে সম্মাননা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। এবং পুরস্কার পেতে 'নিবন্ধনের' জন্য তাদের সাথে যোগাযোগ করার কথা উল্লেখ করা হয়।
সালাহউদ্দিনের কাছে ই-মেইলটি হাস্যকর বলে মনে হয়।
কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই ব্যবসায়ীর কাছে অবশ্য এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব আসার বিষয়টি নতুন নয়। তবে আগে এই ধরনের অফার আসতো চিঠির মাধ্যমে।
সালাহউদ্দিন বলেন, আমি ক্রমাগত এই ধরনের ই-মেইল পাচ্ছি যে তারা আমাকে পুরষ্কার দিতে চায়…তারা আমাকে ১০ জনের মধ্যে থেকে বেছে নিয়েছে…আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না (অথচ পুরস্কার দিচ্ছে), এই ধরনের আজেবাজে কথার একটা সীমা থাকা উচিত।
তিনি আরো বলেন, তারা আমাকে চিনলেও একটি বিষয় ছিল। কিন্তু তারা আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না, তবুও আমাকে একটি পুরস্কার দিচ্ছে এবং আমাকে ক্রমাগত ই-মেইল পাঠিয়ে যাচ্ছে। তারা আরও অনেকের সঙ্গে এভাবে যোগাযোগ করেছে।
এমন অনেক সংস্থা এবং ফোরাম রয়েছে যারা 'শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার' দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতাদের টার্গেট করে।
যদি কেউ আগ্রহী হয়, তিনি শেষ পর্যন্ত হয়তো একটি পুরস্কার পান; তবে নিবন্ধন, বাসস্থান এবং অন্যান্য ফি-এর নামে তাদেরকে একটি মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদান করতে হয়।
অন্যান্য ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলার পর জানা গেছে, তারাও এই ধরনের ই-মেইল পেয়েছেন এবং তাদের কেউ কেউ পুরস্কার পাওয়ার চেষ্টাও করেছেন।
বিজিএমইএ-এর একজন পরিচালক জানান, অনেক সংস্থা এই ধরনের ই-মেইল পাঠায়। দেশের বৃহৎ এক টেক্সটাইল এবং পোশাক প্রস্তুতকারী সংস্থার এই পরিচালক বলেন, আমিও একটি পুরস্কার পাওয়ার ই-মেইল পেয়েছি। কিন্তু আমি সেই ই-মেইল ডিলেট করে দেই।
তিনি আরো বলেন, এসব সংস্থার লোকজন অনেক সময় অফিসেও এসে পড়ে। তবে আমি তাদের ঢুকতে দেই না।
এই পরিচালক প্রতিবেদককে একটি ই-মেইল দেখান। যেখান ভারতীয় এক সংস্থা তাকে 'কোয়ালিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড' নেওয়ার প্রস্তাব দেয়, যে পুরস্কারটি প্রদান করা হবে সিঙ্গাপুরে।
ই-মেইলে জানানো হয় যে, 'কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি, ভবিষ্যত লক্ষ্য, অতীতের সাফল্য, উদ্ভাবনের প্রতি উচ্চ মাত্রার সততা, কোনো কিছুকে টেকসই করার ক্ষমতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ও সময় এবং উদ্ভাবনী চর্চার ভিত্তিতে' পুরস্কারপ্রাপ্তদের বেছে নেওয়া হয়।
অ্যাচিভমেন্টস ফোরামের মতো, এই সংস্থাও তাকে বা তার কাজ সম্পর্কে কিছু না জেনে পুরস্কারের প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু করার জন্য, তাকে নিবন্ধন করতে হবে এবং এখান থেকেই মূলত তাদের ছলচাতুরি শুরু হয়।
সবকিছুকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে, সংস্থা জানায়, অনুষ্ঠানটি যথাযথ মর্যাদার সাথে আয়োজন করা হয় এবং সার্টিফিকেশন খরচ হিসেবে আপনাকে কেবল ৫০০ ডলার দিতে হবে।
এছাড়া বলা হয়, পুরস্কারপ্রাপ্ত সবাইকে তাদের নিজস্ব খরচে ভ্রমণ এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
যারা এসব ই-মেইল পেয়েছেন তারা জানান, ই-মেইলে বা সাড়া দেওয়ার পর দ্বিতীয় ধাপে বলা হয়, অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে জেনেভা বা লন্ডনের মতো ইউরোপীয় কোনো শহরে এবং প্রার্থীদেরকে আবাসন এবং অন্যান্য খরচ বাবদ ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ ডলার দিতে বলা হয়।
সালাউদ্দিন বলেন, এটি সম্পূর্ণরূপে একটি পুরস্কার বিক্রির স্কিম। আমাদের অনেক ব্যবসায়ী এই টাকা অনিচ্ছাকৃতভাবে দিয়ে ফেলেন। কিন্তু কেউ কেউ এগুলোকে ব্র্যান্ডিং সুবিধা হিসেবে মনে করেন। আমি দেখেছি বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকজনকে সেখানে (ইউরোপীয় শহরগুলিতে) যেতে এবং নিজেদের অর্থ খরচ করতে দেখেছি। ফিরে আসার পর তারা পুরস্কার গ্রহণের ছবিসহ নিজেদের কৃতিত্বের কথা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন আকারে ছাপান।
তিনি আরও বলেন, 'এমনকি আমি একজনকে আশুলিয়ায় বিলবোর্ডে পুরস্কারের ছবি প্রদর্শন করতে দেখেছি। পুরো বিষয়টি একটি ফাঁদ এবং প্রতারণা।'
যারা এসব পুরস্কার অফার করে তারা মূলত পুরস্কারপ্রাপ্তদের কাছ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে থাকেন। অভ্যন্তরীণ সূত্রের মতে, যদি তারা রেজিস্ট্রেশন এবং অন্যান্য ফি বাবদ অর্ধ মিলিয়ন ইউরো বা ডলার সংগ্রহ করতে পারে তবে পুরস্কার এবং অনুষ্ঠানে কিছু ব্যয় করে। পরে বিশাল পরিমাণ অর্থ তাদের লাভ থাকে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় বের করা সহজ। কারণ সেগুলো অনলাইনে বিভিন্ন ডিরেক্টরিতে পাওয়া যায়।
সালাহউদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কিভাবে ব্যবসায়ী নেতারা এই পুরস্কার বিক্রেতাদের থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখতে পারেন।
উত্তরে তিনি বলেন, বিষয়টি খুব সহজ। যদি তারা পুরস্কারের বিষয়টি পরিষ্কার হতে না পারে তাহলে তাদের সঙ্গে লেনদেন না করাই ভালো।
তিনি বাংলাদেশ নিযুক্ত বিদেশি দূতাবাসগুলোকে পশ্চিমা দেশের এসব 'পুরস্কার স্কিম' নিয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। সালাউদ্দিন বলেন, কারণ আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশ, যখন কিছু ভুল হয়, প্রথম বিশ্বের দেশগুলি শুরুতে আমাদের দোষ দেয়। দূতাবাসগুলিকে জানানো উচিত যে তাদের দেশের লোকেরা এসব করছে এবং তাদের এইগুলি বন্ধ করতে বলা উচিত।