অপ্রতুল চিকিৎসা, স্যালাইন সংকট: ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীদের দুর্ভোগ কাটছেনা
ঢাকার বাইরে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগী। রোগী বাড়লেও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে এখনো ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের সংকট রয়েছে। হাসপাতালে বেড সংকট, জনবল সংকট, প্লাটিলেট আলাদা করার ব্যবস্থা না থাকায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়ছে রোগীরা। সে কারণে জটিল অবস্থায় ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২১ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে, এদের মধ্যে ১০ জন ঢাকার এবং ১১ জন ঢাকার বাইরে।
একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩,০১৫ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৮৫৭ জন ঢাকার, বাকি ২,১৫৮ জন দেশের অন্যান্য স্থানের।
এদিকে ঢাকার ৩৮১৯ জন সহ সারা দেশের মোট ১০,২৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী এখন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ঢাকার বাইরে ফরিদপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। গত দুই মাসে ফরিদপুরে ডেঙ্গুতে ৩৮ জন মারা গেছে। বর্তমানে ফরিদপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে ৮২১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়লেও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি।
হাসপাতালগুলোতে বেড সংকট তীব্র। অনেক রোগীকে মেঝেতে-বারান্দায়, চলাচলের রাস্তায় বিছানা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে চরম সংকট দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইনের। এছাড়াও কয়েকগুণ বেড়েছে রক্তের চাহিদা। চাহিদা অনুযায়ী রক্ত ও প্লাটিলেট দেওয়া যাচ্ছে না।
ফরিদপুরের মত বাগেরহাটে বেড়েই চলছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় সঠিক সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। বাগেরহাট ২৫০ বেড জেলা হাসপাতালে শুধু ডেঙ্গু রোগীই ভর্তি আছে ৩০২ জন। অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও বেডের তুলনায় ডেঙ্গু রোগী বেশি ভর্তি আছে।
এ হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসা নেওয়া আলোকদিয়া এলাকার নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হাসপাতাল এত অপরিষ্কার তা বোঝানো যায় না। বাথরুমে আলো নাই, ট্যাপ নাই, দরজার সামনে ময়লা। গরিব মানুষ তাই, সরকারি হাসপাতালে এসেছি। কিন্তু এত অপরিষ্কার জায়গায় থাকলে তো অসুস্থ হয়ে যাব।"
ইকবাল হোসেন নামে আরেক রোগী বলেন, "ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু দুর্গন্ধে থাকতে না পেরে মেঝেতে এসে রয়েছি। ওখানে থাকলে মানুষ আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যাবে।"
বাগেরহাট ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার সমাদ্দার বলেন, "শুধু ডেঙ্গু নয়, হাসপাতালে সব ধরণের রোগী বেড়েছে। ঔষধের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও, জনবল সংকটের কারণে রোগীদের সেবা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। যার কারণে মানুষকে কাঙ্খিত সেবা দিতে পারছিনা। এরপরেও আমরা রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।"
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোর আরেকটি হলো লক্ষীপুর। জেলায় ডেঙ্গুর পাশাপাশি ডায়রিয়া রোগীও অনেক বেড়েছে। লক্ষীপুরের প্রাইভেট হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে স্যালাইনের এখনো তীব্র সংকট রয়েছে।
লক্ষীপুরের বন্ধু ফার্মেসির মালিক অঙ্কুর চন্দ্র দেবনাথ বলেন, "আজকে আমার দোকান থেকে ২০ জন রোগী ইনজেকশনযোগ্য স্যালাইন না পেয়ে ফিরে গেছে। প্রতিদিন অন্তত ৫০ ব্যাগ স্যালাইনের চাহিদা নিয়ে রোগী আসে। কিন্তু কোম্পানিগুলো আমাদের স্যালাইন দিচ্ছে না। গত ১৪ দিনে আমি মাত্র ২ ব্যাগ স্যালাইন পেয়েছি।"
বরিশালেও একই চিত্র। ডেঙ্গু রোগীর রক্তের প্লাটিলেট কমে গেলে তাদের চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা নেই বরিশাল বিভাগের কোন হাসপাতালে। রক্তের প্লাটিলেট আলাদা করার যন্ত্র শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকলেও তা পরিচালনার জন্য নেই টেকনিশিয়ান। বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য শের-ই-বাংলা মেডিকেলে পাঠানো হয়। সেখানেও প্লাটিলেট আলাদা করার ব্যবস্থা না থাকায় ক্রিটিক্যাল ডেঙ্গু রোগীদের ঢাকায় আসতে হয়।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর উপজেলা হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু রোগী ঢাকায় না পাঠাতে সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দিয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার পরও ঢাকায় আসছে ডেঙ্গু রোগীরা। বুধবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬৮ জন মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যার মধ্যে ২৪ জনই ঢাকার বাইরের।
এ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, "আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ২৫% ঢাকার বাইরের। নারায়ণগঞ্জ, লক্ষীপুর, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নড়াইল, খুলনা থেকে বেশি রোগী আমাদের হাসপাতালে আসছে। ঢাকার বাইরে থেকে জটিল অবস্থায় রোগীরা আমাদের এখানে আসছে।"
ডিএনসিসি হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কর্নেল একেএম জহিরুল হোসাইন খানও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় আসা রোগীদের মধ্যে ঢাকার বাইরের রোগীই বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম মুশতাক হোসেন টিবিএসকে বলেন, "কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেন্টারে ডেঙ্গু টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে। কোভিডের মত ডেঙ্গু টেস্টের ব্যবস্থা সহজ হলে রোগী শনাক্ত করা সহজতর হবে। এছাড়া হাসপাতালগুলোতে গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা হচ্ছে কিনা তা মনিটর করতে হবে। এখন টেস্টের সুযোগ কম থাকায় ঢাকার বাইরের রোগীরা একেবারে জটিল অবস্থায় ঢাকায় আসছে। এতে ঢাকার হাসপাতালে চাপ বাড়ছে পাশাপাশি রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।"
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেছেন, "স্যালাইন আমদানি করা হয়েছে, এখনো যেসব জায়গায় সংকট আছে তা শিগগিরই কেটে যাবে। ডেঙ্গু বিষয়ে যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে তা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সব সিভিল সার্জনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে প্রতিটি হাসপাতালে র্যাপিড রেসপন্স টিম তৈরি করে। এই টিম যারা অপেক্ষাকৃত খারাপ অবস্থার রোগী, তাদের প্রতিনিয়ত দেখভাল করবে। রোগীর অবস্থা যাতে আরও খারাপ না হয় এবং এ রকম রোগীকে ঢাকার দিকে যেন পাঠাতে না হয়, সেটিও এই টিম তদারকি করবে।"
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন টিবিএসের বাগেরহাট প্রতিনিধি আলী আকবর টুটুল, ফরিদপুর প্রতিনিধি সঞ্জীব দাস এবং লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি সানা উল্লাহ সানু]