মেশিন, তহবিল সহায়তা: ছোট খামারগুলোতেও বসছে দুগ্ধজাত পণ্যের অত্যাধুনিক প্রসেসিং প্ল্যান্ট
বগুড়ার শান্তাহার রোডের 'বগুড়া ভাণ্ডার এগ্রো ফার্মে' গরু-গাভীর সংখ্যা শ'দুয়েক। বছর দুয়েক আগে থেকেই ফার্মের উদ্যোক্তা তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব দুধ প্রসেসিং করে মিষ্টি সহ নানা ধরনের দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি করছেন। এবার অত্যাধুনিক অটোমেটেড মেশিনের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ১.৬৬ কোটি টাকা বিনিয়োগে খামার প্রাঙ্গনেই নতুন একটি কারখানা তৈরি করেছেন।
নতুন কারখানা চালু হলে প্রতিদিন গড়ে ৬৫০ লিটার দুধ প্রসেসিং এর জায়গায় এ উদ্যোক্তা প্রায় ১২০০ লিটার দুধ প্রসেস করবেন। বর্তমানে প্রয়োজনীয় মেশিনারিজ কেনার প্রক্রিয়া চলছে।
শুধু ভাণ্ডার এগ্রোই নয়, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের মোট ১০টি খামার ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আধুনিক কারখানা তৈরিতে বিনিয়োগ করছে। এসব কারখানার বিনিয়োগটা যৌথ। বিনিয়োগের ৫০ ভাগ টাকা দিবে সরকারের লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এলডিডিপি)।
উদ্যোক্তারা এই প্রকল্প থেকে সর্বোচ্চ ৮৩ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ পাবেন বলে জানা গেছে। 'লার্জ স্কেল প্রসেসিং' ক্যাটাগরিতে প্রকল্পের ম্যাচিং গ্রান্টের আওতায় এই টাকা দেওয়া হবে।
প্রকল্পের টাকা পাওয়ার প্রক্রিয়াটা শর্তসাপেক্ষ। উদ্যোক্তাকে এখানে আগে বিনিয়োগ করতে হবে। কারখানা উৎপাদনে আসার পর মেশিনারিজ কেনাকাটার বিল দাখিল করা হলে অনুমোদিত নির্ধারিত অংকের টাকা দেবে সরকারের প্রকল্প।
প্রকল্পের চুক্তিবদ্ধ আরেক প্রতিষ্ঠান ঢাকার মিরপুরের বেলাল ডেইরি অ্যান্ড সুইটস। ঢাকার মিরপুরে দুটি আউটলেটের মাধ্যমে নানা প্রকারের মিষ্টি ও মিষ্টিজাত পণ্য বিক্রি করে তারা। নিজেদের দুটি দুগ্ধ খামার থেকে পাওয়া দুধ দিয়েই এসব পণ্য তৈরি করে তারা।
বেলাল ডেইরির স্বত্বাধিকারী ইউসুফ শামীম টিবিএসকে জানান, তিনি ১.৬৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অত্যাধুনিক মেশিনারিজের মাধ্যমে আরও একটি আধুনিক কারখানা তৈরি করছেন যেখান থেকে অতিরিক্ত পণ্য হিসেবে বাটার ও পনির তৈরি করবেন এবং মিষ্টান্ন তৈরি হবে অটোমেটেড মেশিনের মাধ্যমে।
"মিষ্টির এই কারখানায় প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৩০ হাজার লিটার দুধ প্রসেসিং করা হয়। আধুনিক কারখানা চালুর পর দুধ প্রসেসিং এর পরিমাণ ৫০ হাজার লিটারে পৌঁছাবে," বলেন তিনি।
এলডিডিপি'র চিফ টেকনিক্যাল কোঅর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী টিবিএসকে বলেন, উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত একটি সাপ্লাই চেইন ডেভেলপমেন্টের কাজ করছেন তারা।
"এর একটি অংশে খামারি সহ বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রকল্পের মাধ্যমে দুধ প্রসেসিং এর জন্য যৌথ বিনিয়োগে প্রসেসিং কারখানা তৈরি হচ্ছে। দুগ্ধ ও মাংস উৎপাদনকারীর সঙ্গে মার্কেট লিংকেজ তৈরি করা এই প্রকল্পের একটা বড় উদ্দেশ্য," বলেন তিনি।
স্মল-স্কেল প্রসেসিং প্ল্যান্ট
এলডিডিপি'র আওতায় সারাদেশের ২৩২টি খামার ও উদ্যোক্তা পর্যায়ে স্থাপন করা হচ্ছে স্মল স্কেল প্রসেসিং প্ল্যান্ট। এজন্য প্রতিটি খামার ৪০-৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করছে। এখন পর্যন্ত ৯১টি খামার প্রকল্পের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের প্রসেসিং প্ল্যান্ট তৈরির কাজ শুরু করেছে।
প্রকল্পের শর্তনুযায়ী, এই খামারগুলো প্রকল্প থেকে সর্বোচ্চ ২৪.৯৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ পাবে। এই খামারগুলোও যন্ত্র কিনে প্রসেসিং শুরু করার পরই প্রকল্প থেকে অনুমোদিত টাকা পাবে।
রাজশাহীর পবা উপজেলার ৭ একর জমিতে গড়ে তোলা নাবা ডেইরি অ্যান্ড ক্যাটেল ফার্মের সিনিয়র ম্যানেজার ড. মো. আসাদুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "আমরা বেশ কয়েকটি মেশিনারিজ চেয়েছি প্রকল্পের কাছে। এর মধ্যে পাস্তুরিত দুধ প্রস্তুত, দই-মিষ্টি তৈরির অটোমেটেড মেশিন সহ বিভিন্ন মেশিনারিজ কেনার কাজ চলছে।"
প্রকল্প থেকে চিঠি দিয়ে মেশিনগুলো কেনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশে দুধ প্রসেসিং প্ল্যান্ট তৈরি হয়ে গেলে খামারিদের দুধ বিক্রিতে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উপর জিম্মি হয়ে থাকতে হবে না। দুধের ভালো দামেরও একটা নিশ্চয়তা তৈরি হবে।
আধুনিক খামার পরিচালনা শিখছেন খামারিরা
প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৫৫০০ প্রডিউসার গ্রুপ (পিজি) তৈরি করা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক পিজিগুলোতে চলছে প্রশিক্ষণ।
প্রতি মাসে একটি করে প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয় পিজিগুলোতে। যেখানে খামারের সঠিক ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে কিভাবে রোগবালাই প্রতিরোধ করা যায়, খরচ কমিয়ে পশু পালন করা যায় তা শেখানো হচ্ছে কর্মকর্তাদের মাধ্যমে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পিরিজপুরের ডেইরি পিজির সভাপতি সাধনা ঘোষের খামারে ২২টি গরু রয়েছে। তিনি জানান, মিটিংগুলোতে প্রাণীর বিভিন্ন রোগ সম্মন্ধে সচেতন করা হয়, খামার পরিচালন ব্যয় কমানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। একইসঙ্গে পিজির সদস্যদের ক্রিমির ঐষধ, ক্ষুরারোগের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয় বিনামূল্যে।
খামারিরা নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সংগঠিত হয়ে প্রতি মাসে ব্যাংক একাউন্টে ২০০ টাকা করে জমা করেন।
তবে পবা উপজেলার ডেইরি পিজির সদস্য লাভলি বেগম জানান, তারা স্থানীয় মিষ্টি কারবারিদের কাছে জিম্মি।
অবশ্য দুধ বিক্রির এ সমস্যার সাময়িক সমাধানে এই পিজিতে একটি মিল্ক সেপারেটর মেশিন দেওয়া হয়েছে প্রকল্প থেকে। যেদিন কেউ দুধ বিক্রি করতে পারেন না, সেদিন তিনি এই মেশিনের মাধ্যমে দুধের ফ্যাট আলাদা করে ঘি প্রস্তুত করেন। ঘি বাজারে ১৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
একইসঙ্গে এই প্রকল্পের মাধ্যমে বর্তমানে ২৮৪টি প্রাইমারি স্কুলে প্রতিদিন দুধ খাওয়ানো হচ্ছে, যাতে করে একটি ভোক্তা শ্রেণী তৈরি হয়।
এ বিষয়ে মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাহিদ রশিদ বলেন, "প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা আমরা বাচ্চাদের দুধ খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করছি। এতে বাচ্চাদের স্কুলে আসার প্রবণতা বাড়বে এবং একইসঙ্গে একটি ভোক্তা শ্রেণী তৈরি হবে।"
বিশ্বব্যংক থেকে নেওয়া ৫০০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১৯ এর ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২৫ এর জুন পর্যন্ত।