খামারিদের সংগঠিত করে ডেইরি খাতের উন্নয়নে তৈরি হচ্ছে ‘ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড’
সারাদেশে খামারিদের সংগঠিত করে দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রণয়ন করা হচ্ছে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০২২। এই আইনের আওতায় 'ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড' গঠন করে এ খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি এই সেক্টরের সব ধরনের নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে এই বোর্ডের মাধ্যমে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কেবিনেটে আইনটি অনুমোদনের পর এটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং এর জন্য পাঠানো হয়েছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে পুনরায় অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। সেখানে অনুমোদন হলে সংসদের মাধ্যমে এই আইনটি পাস করা হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোঃ হামিদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং এর কাজ শেষ হলে দ্রুতই আইনটা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কেবিনেটে পাঠানো হবে।'
এ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক দশকে দুধের উৎপাদন ১৫৮ শতাংশ বাড়লেও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে খামারিরা এখনো দুধের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পশুখাদ্য, মেডিসিন, পরিচালন ব্যয় বাড়লেও খামারিদের দুধের মূল্য বাড়েনি। এ কারণে ডেইরিতে অনেক বড় বড় বিনিয়োগ আসলেও তারা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও ভোক্তা পর্যায়ে প্রক্রিয়াজাত দুধের দাম গত চার বছরে ৪৮ শতাংশ বেড়েছে।
ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০২২ মূলত ডেইরি বোর্ড গঠনের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। সরকারি সহযোগিতা, নীতি সহায়তা, বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, খামারিদের সংগঠিত করে ন্যায্যমূল্যে দুধ বিক্রির পরিবেশ তৈরি সহ মনিটরিংয়ের কাজও করবে এই বোর্ড। এছাড়া নতুন নতুন খামার, প্রসেসিং প্ল্যান্ট সহ বিভিন্ন বিনিয়োগের অনুকূলে লাইসেন্স প্রদানের কাজটিও করবে এই বোর্ড।
ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল সহ উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেবে ভারত এখন দুধের উৎপাদনে শীর্ষে। দেশটির এই এক নম্বর অবস্থানে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে এই বোর্ড।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. নাথুরাম সরকার টিবিএসকে বলেন, 'ভারত পাকিস্তান সহ বিশ্বের সব দেশেই ডেইরি বোর্ড রয়েছে। এই বোর্ডই সেক্টরের সব ধরনের উন্নয়ন থেকে শুরু করে পলিসি সাপোর্টের কাজ করে। আমাদের দেশেও ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড একই কাজ করবে। ফলে দ্রুত এই আইন পাস করে বোর্ড গঠন করাটা খুবই জরুরী।'
জানা যায়, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) প্রকল্পের আওতায় ডেইরি বোর্ডের জন্য ভবন নির্মাণের বরাদ্দ রয়েছে। প্রকল্প চলাকালীন সময়ের মধ্যে বোর্ড গঠনের কাজ শেষ করলে এই প্রকল্পের আওতায় সরকার নির্ধারিত স্থানে ডেইরি বোর্ডের ভবন তৈরি করা হবে। ২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে।
আইনের খসড়া থেকে জানা গেছে, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, ডেইরি খামারি, প্রসেসিংয়ে জড়িত ব্যবসায়ীদের নিয়ে ১৮ জনের একটি পরিচালনা পর্ষদ তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে।
অ্যানিম্যাল ব্রিডিং অ্যাক্টসহ চলছে একগুচ্ছ আইন তৈরির কাজ
বর্তমানে উন্নতমানের ষাঁড় দিয়ে দেশীয় গাভীকে প্রজনন সক্ষম করা, কৃত্রিম প্রজনন, ক্লোনিং সহ আরও অনেক প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে বিশ্বজুড়ে। খরচ কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশে কৃত্রিম প্রজনন জনপ্রিয় হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় সরকারের পাশাপাশি মিল্ক ভিটা, লাল তীর, এসিআই, ব্র্যাক সহ বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই এটি করছে।
লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট পলিসি ২০০৮ এ কৃত্রিম প্রজননের বিষয়টা রয়েছে এবং তা মেনে সরকার কাজ করছে। কিন্তু বেসরকারি খাতকে একইভাবে গাইড করা, তারা সরকারি নীতির বাইরে চললে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখন আইনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে।
এ কারণে এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায় অ্যানিম্যাল ব্রিডিং অ্যাক্ট এর খসড়া তৈরির কাজ চলছে। এই খসড়াটি তৈরির কাজ করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। অ্যাক্টের বাস্তবায়নের জন্য রুলস তৈরিরও কাজ চলছে।
একইভাবে পোল্ট্রি খাতের হ্যাচারির কার্যক্রমকে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী গাইড করা, মনিটরিং করার জন্য হ্যাচারী অ্যাক্ট এবং এর বাস্তবায়নের জন্য রুলস, লাইভস্টক পণ্যের উৎপাদন পরবর্তী থেকে শুরু করে রপ্তানি পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপের কার্যক্রম পরিচালনা ও মনিটরিং এর জন্য লাইভস্টক এক্সটেনশন পলিসি ও এক্সটেনশন ম্যানুয়াল তৈরির কাজও করছে এফএও।
এছাড়া লাইভস্টক পণ্যের ফুড সেফটি রিলেটেড স্ট্যান্ডার্ড ও প্রটোকল তৈরির জন্য কাজ করছে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউনিডো।
সবকিছুই করা হচ্ছে এলডিডিপি প্রকল্পের আওতায়। কারণ রপ্তানির জন্য যখন পণ্য উৎপাদন করা হবে তা একটা নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড মেনেই উৎপাদন করতে হবে। যেটা এখন বেঙ্গল মিট ও পোল্ট্রি উৎপাদনে জড়িত কিছু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান করছে।
এলডিডিপির প্রধান কারিগরি সমন্বয়কারী (সিটিসি) ডা. মো. গোলাম রাব্বানী বলেন, 'প্রাইভেট সেক্টরকে ফেসিলিটেড করার জন্য, ডিপার্টমেন্টের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, সার্ভিস প্রোভাইডারদের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য, আমদানি-রপ্তানি পর্যন্ত সব ক্ষেত্রের জন্যই দরকার নানা ধরনের নীতি সহায়তা। তার মধ্যে কিছু এই প্রকল্পের আওতায় করা হচ্ছে।'
প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, 'কৃষির উৎপাদন থেকে উন্নয়ন পর্যন্ত গবেষণার জন্য অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লাইভস্টক খাতের উন্নয়নেও গবেষণা প্রতিষ্ঠান জরুরি।'
বিএলআরআই এর সাবেক মহাপরিচালক ড. নাথুরাম সরকার বলেন, 'লাইভস্টক খাতের রিসোর্সে শুধু বিএলআরআই কাজ করছে, যেটা এত বড় খাতের জন্য যথেষ্ট নয়। ডিম, মুরগি, দুধ, মাংস নিয়ে আলাদা গবেষণার জন্য স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'পোল্ট্রি খাত যেভাবে বিকশিত হয়েছে, সেটাকে ধরে রেখে আরও উন্নয়নের জন্য, আগামীতে রপ্তানির জন্য পোল্ট্রি বোর্ড গঠন করাও জরুরী।'