শ্রম অধিকার, জিএসপি প্লাস নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকা আসছে ইইউ প্রতিনিধিদল
ঢাকায় পৌঁছার আগেই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পুলিশের হয়রানি ও সহিংসতার তদন্ত এবং শ্রমিকদের আন্দোলন ও ধর্মঘট কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সামলাতে করতে পারে, সে বিষয়ে শিল্প পুলিশকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ জাতীয় কর্মপরিকল্পনার (এনএপি) বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ধীর অগ্রগতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) রিভিউ মিশন।
শ্রম অধিকার, জিএসপি প্লাস সুবিধাসহ অন্যান্য উদ্বেগের বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য রোববার (১২ নভেম্বর) পাঁচ দিনের সফরে আসছে ইইউর প্রতিনিধিদল।
সর্বনিম্ন মজুরি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের চলমান বিক্ষোভের মধ্যেই বাংলাদেশ সফর করছে ইইউ প্রতিনিধি দল। গত দুই সপ্তাহে এসব বিক্ষোভে তিনজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া প্রায় দুই ডজন মামলায় কয়েক হাজার শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে।
শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি দমাতে অনেক কারখানার মালিক 'নো ওয়ার্ক নো পে' পথে হেঁটে গতকাল একশোরও বেশি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। কিছু শ্রমিক অধিকার গোষ্ঠী নতুন নির্ধারিত সর্বনিম্ন সাড়ে ১২ হাজার মজুরি প্রত্যাখ্যান করে মজুরি আরও বাড়ানোর জন্য বিক্ষোভ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
গত ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে ইউরোপিয়ান কমিশন বলেছে, 'গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে অগ্রগতি না হওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশের এনএপি প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণের জন্য প্রচেষ্টা এখনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো প্রয়োজন।'
ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার জন্য এনএপির মূল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তা বাড়ানোর ব্যবস্থা, দেশের শ্রম আইন আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ডের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ করা, শ্রম পরিদর্শকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিশু শ্রম নিরসন।
১২ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরকালে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও শ্রম সচিন মো. এহছানে এলাহীর সঙ্গে বৈঠকে ইইউর প্রতিনিধিদল এসব ইস্যু তুলতে পারে।
মিশন ঢাকায় পৌঁছার আগে পাঠানো চিঠিতে এনএপি পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিতে সরকার কী কী উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, তা জানতে চেয়েছে ইইউ। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে বেশ কিছু কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মেয়াদ পেরিয়ে গেছে।
চিঠিতে ইইউ বলেছে, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ড মেনে চলা শুধু বিদ্যমান ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখার শর্তই নয়; বাংলাদেশ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এনএপি বাস্তবায়ন করে, তা-ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জিএসপি প্লাস দেওয়া হবে কি না, তা মূল্যায়নের মূল মাপকাঠি হবে এটি।
এনএপিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইপিজেডগুলোর জন্য শ্রম আইন প্রণয়ন, পর্যাপ্ত শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে নতুন শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা করা, স্বাধীন সমঝোতা ও সালিশ ব্যবস্থা চালু করা এবং ২০২৬ সালের মধ্যে শ্রম আইন আরও সংশোধন করা।
আজ থেকে মূল্যায়ন সুরুয়া করেছে ইইউ মিশন। তবে এনএপি বাস্তবায়নে এ পর্যন্ত বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলে স্বীকার করেছে ইইউ।
ইউরোপিয়ান এক্সটার্নাল অ্যাকশন সার্ভিসেস-এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওলা প্যাম্পালোনির নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলটির আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গেও বৈঠক করার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি সংবাদ সংস্থা ইউএনবিকে বলেছেন, শ্রম খাতের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে 'সামগ্রিক মূল্যায়নের' লক্ষ্যে এই সফর।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, চলমান শ্রমিক অসন্তোষ এবং তাদের দমন করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর বলপ্রয়োগ ইইউ প্রতিনিধিদের বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় হতে পারে।
'এনএপি বাস্তবায়নে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ'
চিঠিতে ইইউ বলেছে, মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক শ্রম মানদণ্ড মেনে চলা শুধু বিদ্যমান ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখার শর্তই নয়; বাংলাদেশ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এনএপি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে, তা-ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস পাওয়ার জন্য যে আবেদন করেছে, তা মূল্যায়নের মূল মাপকাঠি হবে এটি।
চিঠিতে বলা হয়েছে, এ কারণে বাংলাদেশের ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা হবে কি না, তা নির্ধারণের ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে মূল মানবাধিকার কনভেনশনগুলোর বাস্তবায়ন।
ইবিএ অব্যাহত রাখতে ইইউর দেওয়া ৯ দফা কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ একটি 'টাইমবাউন্ড' রোডম্যাপ প্রণয়ন করে ইইউকে জমা দিয়েছে, যা এনএপি নামে পরিচিত। এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের তথ্য ছয় মাস পরপর ইইউকে জানায় বাংলাদেশ।
ওইসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ইইউ বলেছে, এনএপি বাস্তবায়নে অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। এমনকি শ্রমিক অধিকার-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য বাংলাদেশ ইইউকে জানাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছে তারা।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, এনএপির পূর্ণ বাস্তবায়নে আগামী মাসগুলোতে বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নেবে এবং যেসব শর্ত বাস্তবায়নের মেয়াদ ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কতটুকু, সে তথ্য জানতে চায় ইইউ।
শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পুলিশের হয়রানি ও সহিংসতা সম্পর্কে বাংলাদেশ সামান্যই তথ্য দিয়েছে উল্লেখ করে ইইউ বলেছে, 'আমাদের ২০২২ সালের ২১ এপ্রিলের চিঠিতে উত্থাপিত আহত, নিহত বা ট্রেড ইউনিয়ন সভায় যোগ দিতে বাধা পাওয়া শ্রমিকদের ঘটনাগুলোর তদন্ত কোন অবস্থায় আছে, সে বিষয়ে কোনো ফলোআপও দেওয়া হয়নি।'
ইইউ বলেছে, ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইইউকে তেমন একটা তথ্য পাঠানো হয়নি। ইইউ বাস্তব, প্রকৃত ও কার্যকর অগ্রগতি দেখতে চায়, যাতে তদন্ত শুরু হয়েছে এমন ঘটনা এবং শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রতিরোধের পরিকল্পনা নিয়ে তারা আলোচনা করতে পারে।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের ওপর অত্যন্ত নৃশংস দমন-পীড়ন চালানোর বিষয়ে বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলো আইএলওর কাছে অভিযোগ অব্যাহত রেখেছে এবং আইএলও কমিশনের তদন্তের জন্য চাপ দিচ্ছে।
শ্রম আইন
বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইইউ। তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে কিছু খাতে সংগঠন করার স্বাধীনতা না থাকা, ধর্মঘটের অধিকার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ হওয়া এবং বেআইনি ধর্মঘটের জন্য জরিমানা।
কোনো প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকসংখ্যা ৩ হাজারের বেশি হলে, সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি থাকার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা এনএপিতে বর্ণিত লক্ষ্য পূরণ করে না বলে উল্লেখ করেছে ইইউ।
বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা শ্রম আইন এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল (বেজা) আইনকে শ্রম আইনের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ করার শর্ত দিয়েছে ইইউ। সরকার বেজা আইন সংশোধন করলেও ইপিজেড আইন সংশোধন করেনি।
শ্রম পরিদর্শকের ঘাটতি
এনএপির রূপরেখা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রম পরিদর্শকও নিয়োগ করতে পারেনি বাংলাদেশ। যোগ্য শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ দিতে বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নেবে, সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছে ইইউ।
এনএপি অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ ২২৫টি শ্রম পরিদর্শক পদ এবং ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ আরও ৯৪২টি শ্রম পরিদর্শকের পদ পূরণের কথা রয়েছে। তবে যোগ্য প্রার্থীর না থাকায় বাংলাদেশ এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।
ইইউ বলেছে, সরকার এই বাস্তবসম্মত লক্ষ্য অর্জনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। মাত্র ৯৫ জন নতুন পরিদর্শক কাজে যোগদান করেছেন। বাকি পদগুলো পূরণের জন্য অনুরোধ করা হলেও এখনও অনুমোদন হয়নি। বাংলাদেশ সরকার ২০২২ ও ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ শ্রম পরিদর্শক নিয়োগের প্রতিশ্রুতি কীভাবে পূরণ করবে, সে বিষয়ে এনপিতে কোনো ইঙ্গিত নেই বলে উল্লেখ করেছে ইইউ।
সেপ্টেম্বরে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে পাশ করা প্রস্তাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, 'বাংলাদেশকে অবশ্যই তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, বিশেষ করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো মেনে চলতে হবে। সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো যেন বিদেশি অনুদান গ্রহণ করতে পারে, তা-ও কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।'
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্যরা বলেন, বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবাধ বাজার সুবিধা ইবিএ-র পরিসর আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদের লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মামলাটি একটি পশ্চাদ্গামী পদক্ষেপ, যা উদ্বেগের।