নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বাড়তি ১,৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিতে সহায়তা দিতে এবং মূল্যস্ফীতির কারণে উদ্ভূত অতিরিক্ত আর্থিক চাহিদা মেটাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ চেয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে ১ হাজার ৩০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে পুলিশের জন্য। আর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের জন্য (র্যাব) ২৫.৭০ কোটি টাকা ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জন্য ৮৬.৬০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সারা দেশে মোতায়েনকৃত বিজিবি ও আনসার সদস্যদের জন্য অতিরিক্ত ১০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক চিঠিতে অর্থ বিভাগের কাছে এই বাড়তি বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড এবং আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) জন্য অতিরিক্ত এই বরাদ্দ চেয়েছে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশের পর দলটির ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজিবি ও আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়। ওই সময়ই সারা দেশে ২৩০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়, যারা এখনও মাঠে রয়েছে।
জননিরাপত্তা বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাহিনীগুলোকে অর্থবছরের শুরুর পরিকল্পনার বাইরেও কিছু কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত হতে হচ্ছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে বাড়তি কিছু কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকতে হবে এসব বাহিনীকে।
'এছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্য, পোশাকসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের দাম বেড়েছে। যে কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তাদের খোরাকি ভাতা, যাতায়াত ভাতা, ভ্রমণ ব্যয়, পেট্রোল, তেল ও লুব্রিকেন্ট ব্যয়, নিরাপত্তা সামগ্রী, গোয়েন্দা কার্যক্রম, বেতার সরঞ্জাম, মোটরযান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনাসহ বিভিন্ন কাজ বাবদ এই বাড়তি বরাদ্দ চেয়েছে,' বলেন তিনি।
এই বাড়তি বরাদ্দের যৌক্তিকতা জানার জন্য জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফিজুর রহমানের মোবাইলে বারবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ চায় পুলিশ
সূত্রমতে, সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৩০ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ চেয়েছে পুলিশ বিভাগ। এর মধ্যে জ্বালানি খাতে ৬০ কোটি, অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনায় ৪১৪ কোটি, খাদ্যদ্রব্য বাবদ ১০০ কোটি, পোশাক বাবদ ৯৮ কোটি, বেতার সরঞ্জাম বাবদ ১১৪.৫০ কোটি টাকা চেয়েছে। আর নিরাপত্তা সামগ্রী বাবদ চেয়েছে ৫০ কোটি টাকা।
গত ৪ ডিসেম্বর জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় প্রত্যেকটি বাহিনীর আলাদা আলাদা বাড়তি চাহিদা নির্ধারণ করা হয়। ওই সভায় পুলিশের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত আইজিপি আবু হাসান মুহাম্মদ তারিক। সভায় তিনি বলেন, পুলিশের বাড়তি চাহিদা বরাদ্দকৃত বাজেটের বিভিন্ন খাতের সমন্বয়ের মাধ্যমে মেটানো যাবে। এজন্য অর্থ বিভাগের অনুমোদন প্রয়োজন।
তবে বাড়তি বরাদ্দের যৌক্তিকতা জানতে টিবিএসের পক্ষ থেকে আবু হাসান মুহাম্মদ তারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
একইভাবে কোস্ট গার্ডের জন্য প্রায় ৯৭.৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দের যৌক্তিকতা জানতে সংস্থাটির পরিচালক (লজিস্টিকস) ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ হাবিবুল বিল্যাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো মন্তব্য করেননি।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত ২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়েছে র্যাব।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যয়ে আরোপ করা সীমা প্রত্যাহারের অনুরোধ
জননিরাপত্তা বিভাগে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত সূত্র জানিয়েছে, সভায় প্রত্যেকটি বাহিনীর পক্ষ থেকে পেট্রোল, তেল, লুব্রিকেন্ট, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস ও জ্বালানি খাতের ব্যয়ে অর্থ বিভাগ যে সীমা আরোপ করে রেখেছে, তা প্রত্যাহার করে পুরো বরাদ্দ ব্যবহারের সুযোগের পাশাপাশি বাড়তি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
অর্থবছরের শুরুতে অর্থ বিভাগ সরকারের কৃচ্ছ্রতা নীতি বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ খাতের বরাদ্দের সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ এবং পেট্রোল, তেল, লুব্রিকেন্ট এবং গ্যাস ও জ্বালানি খাতের বরাদ্দের সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশের বেশি ব্যয় করা যাবে না বলে জানিয়েছে।
তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ওই সিদ্ধান্ত থেকে অব্যহতি চাচ্ছে। পাশাপাশি পুলিশ এ খাতে ৬০ কোটি টাকা এবং বিজিবি ২৪ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ চেয়েছে।
পুরস্কারের জন্য চাওয়া হয়েছে বাড়তি অর্থ
এদিকে র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড পুরস্কার দেওয়ার জন্য বাড়তি বরাদ্দ চেয়েছে বলে জানা গেছে। পুরস্কার খাতে র্যাবের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে ২.৯৯ কোটি টাকা। এ খাতে সংস্থাটি আরও ১৩ লাখ টাকা চেয়েছে। একইভাবে বিজিবির জন্য বাজেটে ৪.৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। সীমান্তে দায়িত্বপালনকারী এই সংস্থা আরও ৩.১৭ কোটি টাকা চেয়েছে। আর কোস্টগার্ড চেয়েছে বাড়তি ৫ কোটি টাকা। কোস্ট গার্ডের জন্য বাজেটে ১৯.৬০ কোটি টাকা পুরস্কারের জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
জননিরাপত্তা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, চোরাচালান, মাদক কারবার বন্ধসহ বিভিন্ন বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য এসব বাহিনীর সদস্যদের পুরস্কার দেওয়ার বিধান রয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করতে বাড়তি বরাদ্দ চেয়েছে বাহিনীগুলো।
যদিও গত ২৬ নভেম্বর অর্থ বিভাগ এক পরিপত্রে বলেছে, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের প্রাক্কলন অবশ্যই মূল বাজেটের বরাদ্দের মধ্যে থাকতে হবে। কোনোভাবেই অতিরিক্ত বরাদ্দ দাবি করা যাবে না।
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে কিছু বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে এসব বাহিনী যেসব খাতে যত বরাদ্দ চাচ্ছে, সেটা হয়তো দেওয়া হবে না।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'ইতিমধ্যে সংশোধিত বাজেট নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে আলোচনা শুরু হয়েছে। শীঘ্রই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথেও বৈঠক হবে। তখন এসব বাড়তি বরাদ্দের প্রস্তাব আলোচনা সাপেক্ষে নির্ধারণ হবে।'