ডেঙ্গুতে ২৩ বছরের মোট মৃত্যুর দ্বিগুণ ২০২৩ সালে
২০২৩ সালের পুরোটা জুড়েই দেশবাসীকে ভুগিয়েছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশের ২৪ বছরের ডেঙ্গুর ইতিহাসের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে গত বছর।
অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৮৬৮ জন। এ সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৮ জন। ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১ হাজার ৭০৫ জন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, তেইশ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা গিয়েছিল, শুধু ২০২৩ সালেই তার প্রায় দ্বিগুণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এ রোগে।
দেশের প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়।
এর পরে কয়েক বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ কিছুটা কম থাকলেও গত ৫ বছর ধরে ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু।
২০০০ সালের পরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু ধীরে ধীরে কমে এলেও ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করে দেশ। ২০১৯ সালে ১ লাখেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়, আর মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের।
২০২০ সালে করোনার প্রকোপের মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম ছিল। ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৭ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন এবং ২০২২ সালে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে গতানুগতিক পদ্ধতি ছেড়ে ভেক্টর ম্যানেজমেন্টের মধ্যে আসা না গেলে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাবে।
তারা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের বৃষ্টিপাতের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে। এজন্য বছরব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় ।
একসময়ের ঢাকাকেন্দ্রিক ডেঙ্গু এখন ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। ঢাকার তুলনায় এর বাইরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০২৩ সালে ছিল দ্বিগুণের বেশি। তবে সারা দেশের মৃত্যুর ৫৮ শতাংশই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকা নিয়েও নানা মহলে সমালোচনা রয়েছে।
জুলজিক্যাল সোসাইটি অভ বাংলাদেশ-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (জিসিএদ) চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'অনেকেই বলে ডেঙ্গু দমন টেকনিক্যাল ইস্যু, কিন্তু এখানে বড় সমস্যা হচ্ছে সুশাসনের অভাব। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুড গভর্নেন্স জরুরি।'
তিনি বলেন, কীটতত্ত্ববিদরা বারবার ভেক্টর ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে মশা দমন করতে বললেও সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার তা প্রয়োগ করেনি।
তিনি বলেন, এখন যে ডেঙ্গু রোগী কমতে শুরু করেছে সেটি ন্যাচারালিই। সিটি কর্পোরেশন দুর্নীতিমুক্ত না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে না। তারা বিভিন্ন দেশ ঘুরে আসে কিন্তু তাদের সেই পদ্ধতি এপ্লাই করে না।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত এক জরিপে উঠে আসে, ২০২২ সালের বর্ষা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় ঢাকার ভবনগুলোতে লার্ভার উপস্থিতি প্রায় তিনগুণ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের সমস্যা। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সারা বছর ধরে নিয়মিত কর্মসূচি নিতে হবে সব দপ্তরকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপ কার্যক্রমের সঙ্গে ছিলেন কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হলে বছরের শুরু থেকেই পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করতে হবে। এডিসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে তখন ব্যবস্থা নিলে খুব বেশি কার্যকর হয় না।'
তিনি বলেন, শীতের সময়ও ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব অনেক বেশি। এখনই সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ না করলে ২০২৪ সালে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ড. ফজলে শামসুল কবির টিবিএসকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ চলমান রয়েছে।
'আমরা জানুয়ারি থেকেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করব। এখন কিউলেক্স মশা নিধনে কাজ হচ্ছে। বছরব্যাপী মশা নিধনে কাজ করতে আমরা একটি পরিকল্পনা করেছি,' বলেন তিনি।