রিজার্ভ বাড়াতে ব্যাংকগুলো থেকে সোয়াপ করে ডলার নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সোয়াপের মাধ্যমে ডলার সংগ্রহ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশ্বের বহু দেশেই এই ব্যবস্থা চালু থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্রথম এ প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, 'ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রাখতে পারবে। যদিও এর বিপরীতে সমপরিমাণ টাকা নিতে পারবেন—সেক্ষেত্রে এর বিপরীতে নির্ধারিত হারে সুদ দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।'
তিনি বলেন, 'যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ডলার আছে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা দিয়ে প্রয়োজন হলে ডলার রেখে টাকা নিতে পারবে। সময় শেষে টাকা ফেরত দিয়ে ডলার ফেরত নিতে পারবে।
'যেসব ব্যাংকের কাছে শর্তের অতিরিক্ত ডলার থাকে, সেক্ষেত্রে শর্তের কারণে তাদেরকে সেই ডলার বিক্রি করে দিতে হয়। আবার পরবর্তীতে তাদের প্রয়োজনে ব্যাংকগুলো ডলার পাচ্ছে না। এ জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক কারেন্সি সোয়াপের দিকে যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের চর্চা আছে। এর আগে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হয়নি। তাই চর্চা ছিল না।'
মুখপাত্র জানান, এতদিন ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে যখন ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত ডলার থাকত, সেগুলো কিনে নিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মেজবাউল হক জানান, বুধবার (৩১ জানুয়ারি) দেশের ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়ে একটি সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংকগুলোকে ডলার সোয়াপের বিষয়ে বলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২৪ জানুয়ারি শেষে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশে ডলারের সংকট থাকলেও কিছু কিছু ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ রয়েছে।
তপশিলি ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট তাদের ডলার ধারণের সীমা বা বৈদেশিক মুদ্রার নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) হোল্ডিংয়েই ফুটে উঠেছে। বর্তমানে প্রায় ৪০টি ব্যাংকের এনওপি লং পজিশনে রয়েছে।
কোনো ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) হলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে ওই ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা সম্পদ ও দায়ের মধ্যে পার্থক্য। সম্পদ যখন দায়ের চেয়ে বেশি হয়, তখন ওই ব্যাংক এনওপি লং পজিশনে থাকে। আবার দায় যখন সম্পদের চেয়ে বেশি হয়, তখন ওই ব্যাংক এনওপি শর্ট পজিশনে থাকে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংকারদের সভায় গভর্নর এমডিদের আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছেন। এছাড়া ব্যাংক খাতে সুশাসন আনতে প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) আগামী বছর থেকে বাস্তবায়ন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন গভর্নর।
এছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়ে নতুন বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিএ) পদ্ধতির কথা বলেছে গভর্নর। একইসঙ্গে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে বিদেশিদের কাছ থেকে ডলারের প্রবাহ বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
মেজবাউল হক বলেন, পলিসি রেট বা নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে আগামী কয়েক মাস 'টাইট সিচুয়েশন' থাকবে, অর্থাৎ রেপো রেট আরও বাড়তে পারে। তাই ব্যাংকগুলোকে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ডলারের প্রবাহ বাড়ানোর নির্দেশনা
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, ডলারের প্রবাহ বাড়াতে তাদের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে বৈদেশিক মুদ্রার অ্যাকাউন্ট বাড়ানোর জন্য প্রচারমূলক কার্যক্রমে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে ব্যাংকাররা অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে ঋণের সুদহার বাড়ানোরও প্রস্তাব দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
গভর্নর বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, তিনি ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে কোনো আপস করবেন না। মাহবুবুর আরও বলেন, কোন ব্যাংককে কীভাবে একীভূত করা যায়, এমডিদের তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন গভর্নর।
ব্যাংকগুলো এখন সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটের (সোফর) সঙ্গে ৩.৫ শতাংশ যোগ করে সুদহার ধরতে পারে। ব্যাংকাররা এটি বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'সুদের হার বেশি হলে বিদেশি আমানতকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।'
তিনি আরও বলেন, আগামী বছরের মধ্যে ফলাফল পেতে ব্যাংকারদের পিসিএ বাস্তবায়নে সক্রিয় হতে বলা হয়েছে।
২০২৫ সালে বাস্তবায়ন হবে পিসিআর ফ্রেমওয়ার্ক
আর্থিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা বজায় রাখার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক পিসিএ ফ্রেমওয়ার্কের নতুন প্রক্রিয়া চালু করেছে। এ ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে চার ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হবে।
পিসিএর আওতায়, যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৪ শতাংশ ছাড়াবে এবং টানা ২৪ মাস সিআরএআর ৫ শতাংশের নিচে থাকবে, সেই ব্যাংকগুলোকে ক্যাটাগরি ৪-এ রাখা হবে। ওই ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো আমানত গ্রহণ বা নতুন ঋণ দিতে পারবে না।
ব্যাংকগুলোকে তাদের ২০২৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হবে এবং এ কাঠামো ২০২৫ সালের মে মাসে কার্যকর হবে।
খেলাপি ঋণ আদায়ে এডিআর পদ্ধতি
ব্যাংকগুলো যাতে খেলাপিদের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করার আগে সালিশে যেতে পারে, সেজন্য এডিআর নির্দেশিকাতে একটি পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এডিআর পদ্ধতি হলো আদালতের বাইরে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুসরণ করে মধ্যস্থতা সালিশের মাধ্যমে ঋণ আদায় করা।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহককে চিঠির মাধ্যমে জানানো হবে এবং তাকে আইনি জটিলতায় না ফেলে তার থেকে ঋণ আদায় করা হবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করে গ্রাহককে কিছুটা সুদ মওকুফ করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, তপশিলি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার (বিআইএসি) প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমেও গ্রাহকের ঋণ আদায় করতে পারে। যদিও বর্তমানে এমন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে খুবই নগণ্য।