দ্য লাকি ফাইলস: কলেজ শিক্ষক থেকে ‘রাতারাতি’ টাকার কুমির
ইতালির সিসিলিয়ান মাফিয়াদের ওমের্তা আইন বিরাজমান নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায়।
এখানে নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে মিশে আছে ভয়। কেউ কিছু দেখেনি। কেউ কিছু শোনেনি। আর কেউ কিছু জানে না।
লায়লা কানিজ লাকিকে নিয়ে কেউ মুখ খোলে না।
লাকি সাবেক জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী। সম্প্রতি মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কিনতে যাওয়ার পর আলোচনায় আসেন তিনি।
এরপর খবরের শিরোনাম হয়ে ওঠেন মতিউরের প্রথম স্ত্রী লাকি এবং তার বিপুল সম্পদ। ছাগল কেনা ইস্যুর সূত্র ধরে তারা উঠে আসেন আলোচনার কেন্দ্রে।
মাত্র দুই বছর আগেও রায়পুরার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সরকারি কলেজের সাবেক শিক্ষক লায়লা কানিজ ছিলেন অপরিচিত এক নাম।
কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা তো দূরের কথা, তিনি কোনো সাধারণ কর্মীও ছিলেন না।
কিন্তু সেই লায়লা কানিজই এখন উপজেলা চেয়ারম্যান।
স্থানীয়রা তাকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই সবার আগে বলেন 'ভুতুড়ে' লাকি পার্কের (ওয়ান্ডার পার্ক অ্যান্ড ইকো রিসোর্ট) কথা।
ওয়ান্ডার পার্কের ইতিকথা
লায়লা কানিজের সঙ্গে যুক্ত স্থাপনা ওয়ান্ডার পার্ক—স্থানীয়রা যাকে লাকি পার্ক নামে ডাকেন—পরিদর্শনে গিয়ে এ প্রহেলিকার আরেক স্তর উন্মোচিত হয়।
পার্কে প্রবেশের টিকিটের দাম জনপ্রতি ২০০ টাকা, তবে প্রত্যেকটা রাইডে ওঠার জন্য বাড়তি ফি গুনতে হয়।
রিসেপশনিস্ট বাতেন জানালেন: 'প্রতি রাইডের খরচ আলাদা। রাইডে উঠতে উপভোগ চাইলে বাড়তি টাকা দিতে হবে। ভেতরে যান, অপারেটরকে পাবেন।'
তবে পার্কটি দেখা গেল প্রায় নির্জন। রাইডগুলোতে ধুলোর পুরু আস্তর।
কোনো অপারেটরকেও দেখা যাচ্ছে না।
নিস্তব্ধতার মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে পার্কে প্রবেশ করছেন যুগলরা।
ইউটিউবার হিসেবে পরিচয় দিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাংবাদিকরা দর্শকদের কাছ থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন।
সদ্য আগত কয়েকজন বাচ্চার মধ্যে একজন এখনও মনে করতে পারে কয়েক বছর আগে পার্কটি কেমন ছিল।
সে বলল, '৩-৪ বছর আগেও আমরা এখানে খেলতাম। এখানে একটা মাঠ ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। পার্কটি সংস্কার করার পর আমাদের মাঠ হারিয়েছি। এখন আমরা প্রতিদিন পার্কে আড্ডা দিতে আসি।'
আরেক দর্শনার্থী শামীম এক প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়েছিলেন।
তিনি ধূর্ত হাসি দিয়ে নির্জন পরিবেশ দেখিয়ে বললেন, 'এটা শুধু অল্পবয়সি যুগলদের পার্ক। বুঝতেই পারছেন আমি কী বলতে চাইছি।'
পার্কের চারপাশে ঘোরাঘুরি করতে করতে একটি দিঘির গল্প জানা গেল।
দিঘিটি প্রায় ২-৩ বিঘা জমিজুড়ে বিস্তৃত। ধবধবে সাদা হাঁস সাঁতার কাটছে দিঘিতে, জলকেলি করছে।
দর্শকদের জিজ্ঞেস করা হলো, 'এটাই কি লাকি ম্যাডামের মৎস্য খামার?'
কিন্তু কেউই তথ্যটি নিশ্চিত করতে পারলেন না।
কেউ পার্কের আয়তন নিশ্চিত করতে না পারলেও দেখে মনে হলো ১৫-১৬ বিঘার কম হবে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্কটি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত একজন বলেন, '২০১৯ সালে যখন পার্ক বড় করল, তার আগে আপা (কানিজ) শুধু ওখানকার জমির মালিকদের ডেকে জানিয়ে দেন যে তার জমি লাগবে। দাম নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আবার জমি না দিয়েও উপায় ছিল না, কারণ তারা ক্ষমতাধর।'
তিনি আরও বলেন, 'পার্কের ভেতরে যে দিঘিটা আছে, সেটা প্রায় ২০০ শতক জমিজুড়ে। ওটা সিরাজ মিয়া নামের একজনের ছিল। এছাড়া তার পাশেই কাওছার মোল্লা, সুলতান মোল্লাসহ বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে জমি নিয়েছেন তারা। মালিকরা জমির ন্যায্য দাম পাননি। আপা যাকে যেটা দিয়েছেন, সেটাই নিতে বাধ্য ছিলেন।
'এছাড়া দুলু নামের একজনের জমিও জোর করে নেন। তারা এখনও সম্ভবত টাকা পায়নি। ২০১৯ সালের দিকে জমিগুলো নিয়ে নেন তিনি। পার্কও ওই সময়ে বড় করেছে। এর আগে তো ছোট একটা পার্ক ছিল।'
'টাকার কুমির'
লায়লা কানিজ ও তার পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ওই স্থানীয় সূত্র টিবিএসকে তার পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কেও জানালেন।
তিনি বলেন, 'কানিজের বাবা কফিল উদ্দিন আহম্মেদ তেমন অর্থ-সম্পদের মালিক ছিলেন না। তাকে সবাই কফিল মাস্টার হিসেবে চিনত। তিনি ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটি মাটির ঘরে থাকতেন।
'তবে কানিজের হঠাৎ ধনী হয়ে যাওয়ায় অবাক এলাকাবাসীও। কীভাবে হঠাৎ এত টাকার মালিক হলেন তিনি, ঠিক বুঝলাম না। এখানে বাড়িটা করার পরই আসলে তার সম্পত্তি প্রকাশ পায়। বছর দুই আগে তিনি বাড়িটা বানিয়েছেন। এলাকায় এককথায় তাকে "টাকার কুমির" বলা শুরু হলো। এর আগেই তিনি পার্ক করেছেন, কিন্তু সেটা নিয়ে এত বেশি আলোচনা ছিল না।'
তিনি আরও বলেন, 'এমনকি তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার বিষয়টাও ছিল অবাক করার মতো। চেয়ারম্যান হওয়ার পর আসলে তাকে সবাই চিনতে শুরু করে। এর আগে তিনি যে রাজনীতি করেন, সেটা মানুষের অত বেশি জানা ছিল না। স্থানীয় অনেকেই মনে করেন, কানিজ এসব সম্পদ গড়েছেন তার স্বামীর অবৈধ উপার্জনেই। শিক্ষকতার আয়ে বা পেনশনের টাকায় এত সম্পদ হতে পারে না।'
তিনি বলেন, 'রায়পুরা ছাড়াও পুবাইল ও সিলেটেও তার পার্ক আছে বলে শুনেছি। তবে সেগুলোর নাম জানি না।'
পার্কের পাশেই থাকেন একজন মহিলা। পার্ক বড় করার জন্য তার জমি নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, 'তারা আমাদের ১২ শতক জমি নিয়েছেন। তখন প্রতি শতক জমির দাম ছিল ৬০ হাজার টাকা। তারা আমাদের মাত্র ১ লাখ টাকা দিয়েছেন, এখনও আমরা বাকি টাকা পাইনি।'
আরও কয়েকজন একই গল্প শোনালেন—কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা পেয়েছেন বা তাদের জমির ন্যায্য মূল্য পাননি।
কিন্তু লায়লা কানিজ যদি টাকা পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে তিনি কি সত্যিই বিলাসী জীবন যাপন করতেন? নাকি পুরোটাই একটা মুখোশ ছিল?
এর পরের গন্তব্য লায়লা কানিজের বাড়ি, অথবা তার প্রাসাদও বলা চলে।
চাকচিক্যের ছড়াছড়ি
রায়পুরার মরজাল হাইস্কুল থেকে একটি ইউ-টার্ন নিলেই লায়লা কানিজের বাড়ির রাস্তা।
আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি তার বাড়িটি আশপাশের অন্য বাড়িদের চাইতে আলাদা।
আশপাশের অন্যান্য বাড়ির চেয়ে একেবারেই অন্যরকম তার আলিশান বাড়িটি।
বিলাসবহুল সাদা ডুপ্লেক্স বাড়িটি দেশি-বিদেশি গাছের সারিতে ঘেরা। বাড়ির সামনে সবুজ প্রাঙ্গণ। এছাড়া কাছেই কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা এবং অবসর সময় কাটানোর জন্য নান্দনিক স্থাপনা আছে।
এই চিত্তাকর্ষক পরিবেশেও সেখানে রাজত্ব করছে এক বিস্ময়কর নীরবতা।
ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক লায়লা কানিজ ১৬তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেন।
তিনি এখন যে ঐশ্বর্যে মোড়ানো জীবন যাপন করছেন, তার সঙ্গে লায়লা কানিজের কর্মজীবনের তীব্র বৈপরীত্য।
এমন পেশাজীবনের একজন মানুষ কীভাবে এরকম প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করলেন?
'কেউ জানে না'
টিবিএসের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নরসিংদী-৫ আসনের সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ পুরো ঘটনা থেকে দায়মুক্তি নিলেন।
তিনি বলেন, 'দলে লায়লা কানিজের অবস্থান সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। কেন তাকে মনোনয়ন দিয়েছে, জেলা আওয়ামী লীগই ব্যাখ্যা করতে পারবে। তখন আমি জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম না।'
এই সংসদ সদস্য আরও বলেন, 'আমি তাকে দলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিইনি, এতে আমার কোনো ভূমিকাও ছিল না।'
তিনি বলেন, অনেকদিন আগে ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠানে লায়লার সঙ্গে তার দেখা হয়।
এলাকার অনেকেরই অভিযোগ আছে, অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের পাশ কাটিয়ে রাজিউদ্দিনই তাকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানিয়েছেন—এমন কথা জানালে তিনি বলেন, 'আমি তাকে চেয়ারম্যান করিনি। জনগণ যাকে চেয়ারম্যান করতে চায়, তাকেই বেছে নেয়।'
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ রয়েছে।
হলফনামায় সম্পত্তি
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় দেখা গেছে, লায়লা কানিজের বার্ষিক আয় কৃষি খাত থেকে ১৮ লাখ টাকা। এছাড়া বাড়ি-দোকান ও অন্যান্য ভাড়া থেকে আসে বছরে ৯.৯০ লাখ টকা, শেয়ার-সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানতের লভ্যাংশ থেকে প্রায় ৩.৮২ টাকা লাখ আয় করেন। উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানী বাবদ পান ১.৬৩ লাখ টাকা ও ব্যাংক সুদ থেকে প্রায় ১.১৯ লাখ টাকা আসে।
এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা রয়েছে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
লায়লা কানিজের স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে ঢাকা-সাভারসহ বিভিন্ন জায়গায় মোট ১৮.৫ কাঠা জমি আছে। এছাড়া গাজীপুরের বিভিন্ন জায়গায় ৯৯.৬৫ শতাংশ জমি আছে। পাশাপাশি তার নিজ জেলা নরসিংদীতে ৩৬৪.৯৩ শতাংশ জমি আছে।
এর বাইরেও যশোর ও নাটোরে তার জমি আছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও তার নামে ১৫৪ শতাংশ কৃষিজমি আছে।
এদিকে লায়লা কানিজের কর রিটার্ন অনুযায়ী, ঢাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে।