চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে মুক্ত বাণিজ্য ছাড়িয়ে নজর বাংলাদেশের
বাংলাদেশ ও চীন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে আলোচনার বদলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা)-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্য, অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৮–১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় আনুষ্ঠানিক আলোচনার ঘোষণা দেওয়া হতে পারে।
গত মাসের শেষের দিকে ভারতের সঙ্গে সেপা আলোচনা শুরু করার জন্য বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চুক্তির পর এমন পদক্ষেপের কথা জানা গেল। এছাড়াও, বাংলাদেশ গত বছর ইকোনমিক পার্টনার্শিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ)-এর জন্য জাপানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে।
এফটিএ'র ওপর পরিচালিত যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও চীন এখন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর জন্য সেপা পদ্ধতির কথা বিবেচনা করছে।
এফটিএ পণ্যের ওপর শুল্ক এবং বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা হ্রাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করে। অন্যদিকে সেপা পরিষেবা, বিনিয়োগ, মেধাসম্পদ অধিকার, সরকারি ক্রয়, বিরোধ এবং নিয়ন্ত্রক দিকগুলো নিয়ে কাজ করে।
বাণিজ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার পাশাপাশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, প্রযুক্তি সহায়তা নিশ্চিত করা এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর দৃষ্টি রেখে ২০২৬ সালে এলডিসি-উত্তরণ পরবর্তীসময়ে বাংলাদেশ এর অর্থনৈতিক ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার জন্য বহুমুখী বাণিজ্য কৌশল অনুসরণ করছে।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী তার চীন সফরের বিভিন্ন চুক্তি চূড়ান্ত করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এফটিএ বা সেপা; যে কোনো বাণিজ্য চুক্তি বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে মিল রেখা করা উচিত।
'বাংলাদেশের ম্যান-মেইড ফাইবারে বিপুল বিনিয়োগ দরকার, যেখানে চীন বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্বে রপ্তানিতে চীন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। তারা [চীন] আমাদের আরএমজি-বহির্ভূত খাতেও বিনিয়োগ করতে পারে এবং বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে,' বলেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক এমএ রাজ্জাক।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, চীন বাংলাদেশ থেকে উচ্চমানের পণ্য আমদানি বাড়ানোর প্রস্তুতির কথা ব্যক্ত করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে ১৭টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর এবং ১৪টি বিষয়ে যৌথ ঘোষণা হতে পারে।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মহাসচিব আল মামুন মৃধা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চীন আসিয়ানের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর করার পর থেকে ভিয়েতনামের মতো আসিয়ান দেশগুলোতে চীনা বিনিয়োগ এবং বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ যদি চীনের সঙ্গে সেপা বা এফটিএ স্বাক্ষর করে, তাহলে এখানেও বিনিয়োগ বাড়বে।'
'চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আইসিটি, টেক্সটাইল, অটোমোবাইল, চামড়া এবং সোলারসহ ২০টি সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। চীনা প্রতিনিধিরা এসব খাতে বিনিয়োগের পরিবেশ এবং সুযোগ-সুবিধা মূল্যায়ন করতে প্রতিমাসে পরিদর্শন করে,' মৃধা বলেন।
'আমরা আশাবাদী যে, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হলে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে,' তিনি আরও বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় যে-সব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে তার মধ্যে একটি হলো 'কমপ্রিহেন্সিভ ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন'।
'পক্ষগুলো পারস্পরিক সম্মত খাতে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্য রাখবে,' টিবিএস-এর দেখা খসড়া সমঝোতা স্মারকে এমনটাই লেখা হয়েছে। এটি সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে পাট, কৃষি ব্যবসা, আইসিটি, হালকা প্রকৌশল, চামড়াজাত পণ্য, পোশাক, গবেষণা এবং শিক্ষামূলক পরিষেবার কথা উল্লেখ করেছে।
এছাড়া, এ সমঝোতা স্মারকটিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে উন্নীত করার জন্য অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সহযোগিতার উদ্যোগের বিষয়ে আলোচনাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
চীনের নেতৃত্বাধীন আন্তঃসীমান্ত ডিজিটাল মুদ্রা উদ্যোগ এমব্রিজ-এ যোগদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক চায়না ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স রেগুলেটরি কমিশনের সঙ্গে আরেকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ যদি এমব্রিজ-এ যোগ দেয়, তবে এটি অন্য সদস্য চীন, হংকং, থাইল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনা করার সক্ষমতা অর্জন করবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ রেলওয়েসহ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চীনা ঋণ পাওয়ার লক্ষ্যে 'কো-অপারেশন ইন দ্য ফিল্ড অব ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন' শীর্ষক একটি এমওইউ স্বাক্ষর করতে পারে।
মোংলা অর্থনৈতিক অঞ্চলের বৃহত্তম পিএসএফ এবং পিইটি বোতল ও টেক্সটাইল-গ্রেড কারখানায় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের জন্য দেশবন্ধু গ্রুপ, কেমটেক্স এবং চায়না ন্যাশনাল কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএনসিইসি)-এর মধ্যে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে।
উৎপাদন শুরু হওয়ার পর চীন-অর্থায়নকৃত কারখানাটি বার্ষিক এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অন্যান্য চুক্তির মধ্যে থাকবে ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ এবং নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু প্রকল্প।
এছাড়া, বাংলাদেশ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক নির্মাণ এবং খুলনায় চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তিকে অপ্টিমাইজ করার বিষয়ে আলোচনা শুরু করা এবং পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, নিষ্কাশন, কঠিন বর্জ্য এবং ছোট পৌরসভার পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি প্রকল্পের অনুমোদনসহ বেশ কয়েকটি ঘোষণা আসতে পারে।
বাংলাদেশ চীনের কাছে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা এবং দুই বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সহায়তা চেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় এসব অনুরোধের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৯ জুলাই বেইজিংয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর আয়োজনে 'সামিট অন ট্রেড, বিজনেস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অপারচুনিটিজ বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড চায়না' শীর্ষক দিনব্যাপী সম্মেলনে যোগ দেবেন।
এফটিএ-এর পরিবর্তে সেপা কেন?
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, যেখানে চীন ইতোমধ্যেই শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তাই এফটিএ-এর মাধ্যমে চীনে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ কম। পরিবর্তে সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রপ্তানি বাড়াতে আরও চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
অন্যদিকে, ভারতের মতো চীনও বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি সহায়তাসহ অন্যান্য ক্ষেত্র সম্পৃক্ত করে সেপা স্বাক্ষর করতে আগ্রহী। ফলে প্রস্তাবিত এফটিএ-কে সেপায় রূপান্তর করতে সম্মত হয়েছে উভয় দেশ। চলতি বছর দুই দেশ সেপা স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা শুরু করবে।
চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য অংশীদার এবং দেশের আমদানির বৃহত্তম উৎস। ঐতিহাসিকভাবে, রপ্তানির পরিমাণ কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে বড় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।
২০১৬ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এফটিএ-এর যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশ চীনা ট্যারিফ লাইনের ৯৮ শতাংশের বেশি শুল্কমুক্ত সুবিধা উপভোগ করে। তবে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি কখনোই এক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়নি, যেখানে চীন থেকে আমদানি ২০২১–২২ অর্থবছরে ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০২২–২৩ অর্থবছরে এ আমদানির পরিমাণ ছিল ২৩.৫৯ বিলিয়ন ডলার।
চীনে বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় ৪৪ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। চীন মূলত শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে বিক্রি করে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক এমএ রাজ্জাক উল্লেখ করেছেন, চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানির ৪০ শতাংশ রপ্তানি খাতের কাঁচামাল হিসেবে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়।
তিনি বলেন, 'চীনের সঙ্গে এফটিএ জিডিপি, রপ্তানি ও আমদানিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণে ইঙ্গিত রয়েছে।'
১ জুলাই টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে অধ্যাপক রাজ্জাক বলেন, সেপা এফটিএ-এর তুলনায় আরও ব্যাপক সুবিধা দেবে।
'তবে [চুক্তি] যে নামেই হোক না কেন, এটির জন্য চীনা বিনিয়োগ-সমর্থন থাকা উচিত। এসব বিনিয়োগ আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারের জন্য চীনা বিনিয়োগ আসতে হবে,' তিনি বলেন।
২০১৮–১৯ থেকে ২০২৩ সালের জুনের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে চীনের নিট বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) মোট পরিমাণ ১.৯৫ বিলিয়ন ডলার। এর বেশিরভাগই বিদ্যুৎ খাতে। আর উল্লেখযোগ্য কিছু বিনিয়োগ রয়েছে টেক্সটাইল, নির্মাণ এবং ব্যবসায় খাতে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে গত এক দশকে চীন বাংলাদেশের অবকাঠামোতে প্রায় ৪.৪৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাক বলেন, 'চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবোটিক্সসহ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রযুক্তির উন্নয়নে এগিয়ে রয়েছে। চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশ লাভবান হবে।'
তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সেপা বা এফটিএ-এর শর্তাবলী উভয়পক্ষের জন্য সমান হওয়া যাবে না এবং বাংলাদেশের বাজার ধীরে ধীরে চীনের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।