মৃতদের জনপদ: কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় নিহত ৩৯ জনের বাড়ি বরিশাল বিভাগের ৩ জেলায়
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে উদ্ভূত সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে অন্তত ৩৯ জনের বাড়ি বরিশাল বিভাগে। এরমধ্যে বরিশার জেলার বাসিন্দা ১০ জন, ভোলা জেলার বাসিন্দা ১৮ জন ও পটুয়াখালী জেলার ১১ জন। তাদের অধিকাংশই গুলিতে নিহত হয়েছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
নিহতদের পরিবার ও অধিকাংশ নিহতদের যেখানে দাফন করা হয়েছে, সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন নিম্ন-আয়ের মানুষ। ঢাকায় দিনমজুর, পোশাক কর্মী, হোটেল ও রেস্টুরেন্টের কর্মী, মোটর ওয়ার্কশপে কর্মী, ট্রাক চালক, ভ্যান চালক ও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন তারা।
এছাড়া নিহতদের মধ্যে পাবলিক-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও বিএনপি কর্মীও রয়েছেন।
একজন ভুক্তভোগী সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাওয়ার সময় সংঘর্ষের মুখে পড়ে নিহত হন।
নিহতদের পরিবারে একদিকে চলছে শোকের মাতম, অন্যদিকে বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তাও। অনেকের পরিবারের আয়ের মাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে।
বিভিন্ন সূত্র ও নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অধিকাংশই সংঘর্ষে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। বেশিরভাগই কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে অথবা বাড়ি থেকে থেকে কাজে ফেরার পথে কিংবা কাজ করার সময় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা গেছেন।
তাদের অধিকাংশই নিহত হয়েছেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, রামপুরা, মহাখালী, উত্তরার মতো এলাকাগুলোতে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতার সময় তারা নিহত হন। এ সহিংসতায় ২০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে মৃতের সংখ্যা এখনও প্রকাশ করা হয়নি, তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেছেন, তারা মৃত্যুর সংখ্যা যাচাইয়ের কাজ করছেন। তবে বিস্তারিত নিশ্চিত হতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেসব জেলায় সহিংসতায় নিহতদের লাশ দাফন করা হয়েছে, জেলা এসবির কর্মকর্তারা ওইসব জেলার তথ্য সংগ্রহ করছেন।
বরিশাল জেলার ১০ জন
বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জের দুজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রহমতপুর ইউনিয়নের মহিষাদী গ্রামের জাকির হোসেনের ছেলে, চট্টগ্রাম ওমরগনি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২২) ১৬ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ১৯ জুলাই ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন বাবুগঞ্জের বাহেরচর ইউনিয়নের ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামের মিজানুর রহমান বাচ্চুর ছেলে আব্দুল্লাহ আল আবির (২২)। তিনি ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্টাফ ছিলেন।
বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার দুজন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কালনা গ্রামের নজরুল ইসলাম খলিফার ছেলে, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ইমরান খলিফা (৩২) ১৯ জুলাই ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসে যাওয়ার সময়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন বলে জানিয়েছেন পিতা নজরুল ইসলাম।
একই উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের মহসিন সিকদারের ছেলে জামাল সিকদারের (৩৭) শনিবার (২০ জুলাই) সৌদি আরবের ফ্লাইটে দেশ ত্যাগ করার কথা ছিল। শুক্রবার (১৯ জুলাই) বাড়ি থেকে গিয়ে শনিবার এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সময়ে যাত্রাবাড়ী শনির আখড়া এলাকায় সংর্ঘর্ষের মুখে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান বলে জানিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া ইউনিয়নের পানবাড়িয়া গ্রামের জাকির খানের ছেলে শাওন খান (১৯) ঢাকার রামপুরার একটি ভাতের হোটেলে কাজ করতেন। শুক্রবার (১৯ জুলাই) জুমার নামাজের পর হোটেলে যাওয়ার সময়ে রামপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি।
হিজলা উপজেলার বড় জালিয়া ইউনিয়নের খুন্না গোবিন্দপুর গ্রামের মো. হাসানের ছেলে শাহিন (২২) ও হিজলা গৌরবদি ইউনিয়নের চর দেবুয়া গ্রামের নাঈম সরদারের ছেলে নোমান (২৩) শুক্রবার (১৯ জুলাই) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। তারা দুজনেই ঢাকায় পড়াশোনা করতেন। এরমধ্যে শাহিনের দাফন গ্রামের বাড়িতে হলেও নোমানকে ঢাকায় দাফন করা হয়।
বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবদুল মান্নানের মেজো ছেলে জসীম উদ্দিন (৩৭) ঢাকার উত্তরা ৭ নং সেক্টরে একটি অটোমোবাইলসের দোকানে চাকরি করতেন। শুক্রবার (১৯ জুলাই) দোকানের কাজে বের হলে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ওই ইউনিয়নের বেতাল গ্রামের বাসিন্দা আল আমিন রনি (২৫) মহাখালীর একটি ওয়ার্কশপে কাজ করতেন। ওয়ার্কশপের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শুক্রবার তিনি নিহত হন।
সলিয়াবাতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ২১ জুলাই তাদের নিজ নিজ বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।
বাকেরগঞ্জ উপজেলার সাটিবুনিয়া গ্রামের রবিউল হাসান (২৬) রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় একটি ইলেকট্রিক দোকানের মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। ২০ জুলাই শনির আখড়া দিয়ে দোকানে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তিনি।
বাকেরগঞ্জের একজন ওয়ার্ড মেম্বার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নিহত রবিউলের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। তার পরিবারটি খুবই অসহায়। ২২ জুলাই লাশ সাটিবুনিয়া গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।
বরিশাল পুলিশ সুপার কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, নিহতদের মধ্যে ৯ জনের দাফন বরিশালে যার যার বাড়িতে হয়েছে। 'একজনের দাফন ঢাকায় হয়েছে বলে শুনিছি। তার সর্ম্পকে আমাদের কাছে তথ্য নেই।'
ভোলা জেলার ১৮ জন নিহত
ভোলা জেলার চার উপজেলার ১৮ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ভোলা সদর উপজেলার বাসিন্দা তিনজন।
স্থানীয় জনপ্রতিনধি ও জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তারা ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংসতায় নিহত হন। তাদের দাফন গ্রামের বাড়িতে করা হয়েছে।
এর মধ্যে আলীনগর ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের নান্টু কাজীর ছেলে ইমন কাজী (২২), পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. শামিম (২৫) ও কাচিয়া ইউনিয়নের দেলোয়ার (৪৫) হোসেন ১৯ জুলাই গুলিদ্ধি হয়ে নিহত হন। এরমধ্যে দেলোয়ার হোসেন শ্রমিক ছিলেন, বাকি দুজন শিক্ষার্থী।
এছাড়া বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের লাল মিয়ার ছেলে ইয়াছিন (২৩), আবুল হোসেনের ছেলে জামাল হোসেন (৩২) ও সাচড়া ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা লিজা নিহত হন। লিজা ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন। সাচড়া ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের সিরাজের ছেলে মো. সুজন (৩০) এবং বড় মানিকা ইউনিয়নের জনি মাতব্বরের ছেলে মো. নাইম (২১) সহিংসতায় নিহত হন।
সংঘর্ষে নিহতদের পাঁচজন ছিলেন ভোলার লালমোহন উপজেলার বাসিন্দা।
লালমোহন উপজেলার কালমা ইউনিয়নের খলিলুর রহমানের ছেলে আবুল বাসার শাহাবুদ্দিন (৩৫), বজলুর রহমানের ছেলে আক্তার হোসেন (৩০), লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের ইউসুফ আলীর ছেলে আরিফ (২৫), পশ্চিম চর উমেদ ইউনিয়নের হানিফ হাওলাদারের ছেলে মাওলানা মোসলেউদ্দিন (৪০) এবং ধলী-গৌরনগর ইউনিয়নের সফিকুর রহমানের ছেলে হাবিবুর রহমান সহিংসতায় নিহত হন।
এছাড়া চরফ্যাশন উপজেলার ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের শফিকুর রহমানের ছেলে মো. সিয়াম (১৮), হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের স্বপনের ছেলে মো. সোহাগ (২৭), রসুলপুর ইউনিয়নের জাফর মিয়ার ছেলে মনির উদ্দিন (২৩), নীল কমল ইউনিয়নের আবু ইউসুফের ছেলে মো. হোসেন (২৫) ও নজরুল নগর ইউনিয়নের আলমগীর হোসেনের ছেলে মো. হাসনাইন (১৫) নিহত হন।
পটুয়াখালীর ৬ উপজেলার ১১ জন
ঢাকায় সংঘর্ষে পটুয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলার ১১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বাউফল উপজেলায় পাঁচজন, সদর উপজেলার দুইজন, দুমকি উপজেলার একজন, দশমিনা উপজেলার একজন, গলাচিপা উপজেলায় একজন এবং রাঙ্গাবালী উপজেলার একজন রয়েছেন।
তাদের মধ্যে পটুয়াখালী পৌর শহরের বাসিন্দা রতন চন্দ্রের ছেলে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া (২৩) শুক্রবার ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
ঢাকার পোস্তগোলা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন কবি নজরুল ইসলাম কলেজের ছাত্র মো. জিহাদ মোল্লা(২২)। তিনি দশমিনা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. নুরুল আমীন মোল্লার ছেলে।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ঢাকা টাইমস-এর স্টাফ রিপোর্টার মো. মেহেদী হাসান (৩১)। তিনি পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ধুলিয়া ইউনিয়নের উত্তর হাসনাবাদ গ্রামের মো. মোশারফ হোসেনের ছেলে।
যাত্রাবাড়ী এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হন ভ্যান চালক জাহাঙ্গীর হোসেন (৪৫)। তিনি বাউফল উপজেলার মদনপুরা ইউনিয়নের দিপাশা গ্রামের মো. মইন উদ্দিন মৃধার ছেলে।
ঢাকার দনিয়া এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় শিশুশ্রমিক মো. আমীন( ১৬)। সে বাউফল উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়নের ভরিপাশা গ্রামের মো. ওবায়দুল খাঁ-র ছেলে।
ঢাকার পল্টনে পুলিশ ও বিএনপির সংঘর্ষে নিহত হন বাউফল উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক নবীন তালুকদার (২৮)। তিনি বাউফল উপজেলার সূর্যমনি ইউনিয়নের ইন্দ্রকুল গ্রামের মো. ফখরুলের ছেলে। একই ঘটনায় নিহত হয়েছেন মো. জিহাদ (২২) নামে এক ছাত্রদলকর্মী। তিনি একই উপজেলার সূর্যমনি ইউনিয়নের মো. কবিরের ছেলে।
ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পটুয়াখালীর দুজন ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে মো. শাহ-জামাল (২৬) রাঙ্গাবালী উপজেলার মৌডুবি ইউনিয়নের খাস মহল গ্রামের মো. হারুন ভূইয়ার ছেলে। অপরজন মো. মিলন (৩০)—তিনি দুমকি উপজেলার ঝাটরা এলাকার মো. হোসেন হাওলাদারের ছেলে।
এছাড়া গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. শাহ আলমের ছেলে, গার্মেন্টসকর্মী মো. আতিকুল ইসলাম রুবেল (৩৪) এবং পটুয়াখালী সদর উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের হকতুল্লাহ গ্রামের মো. সুলতান সরদারের ছেলে, ট্রাক চালক মো. দুলাল (৩৫) সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনধি এবং পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।