দুই গুলিতে মরলো ফয়েজ; ‘স্বামী ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোনও আপনজন নেই’
সংসারের হাল ধরতে অল্প বয়সেই প্রবাসী ভিসায় মালদ্বীপ পাড়ি জমান মো. ফয়েজ (৩২)। করোনার ধাক্কায় ২০২০ সালে চাকরি হারিয়ে মালদ্বীপ থেকে ফিরতে হয় দেশে। পরিবারের অভাব ঘুচাতে এবার ঢাকায় পাড়ি দেন এ যুবক। ঢাকায় ফিরে স্যানিটারি মিস্ত্রির (পাইপ ফিটার) কাজ শুরু করেন। এর মাঝে গাজীপুরের টঙ্গীর বাসিন্দা মা-বাবাহারা ভাই-বোনহীন এতিম মেয়ে নুর নাহারকে ভালোবেসে বিয়ের করেন। বিয়ের ৪ বছরের মাথায় তাদের ঘরে জন্ম নেয় রাফি মাহমুদ। রাফির বয়স এখন মাত্র ১৮ মাস। তিনজনের সংসার খুব ভালোই চলছিল। কিন্ত মাত্র ২টি গুলিতেই তছনছ হয়ে গেছে ফয়েজ-নাহার দম্পতির ছোট্ট পরিবার।
মো. ফয়েজ লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিলের ইউনিয়নের পশ্চিম ঝাউডগি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।
তাঁর মা সবুরা বেগম জানান, ঢাকায় গোলযোগের কথা শুনে গত ২১ জুলাই সন্ধ্যার একটু আগে আমি তাকে বাড়ি থেকে ফোন করি। তখন সে কাজ শেষ করে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার নিজ বাসার দিকে যাচ্ছিল। এসময় ছেলে বললেন, 'কাজ শেষ করে বাসার দিকে বের হয়েছি মা। রাস্তায় অনবরত গুলি হচ্ছে। মা, এখন ফোন রাখ।' কথার একপর্যায়ে হঠাৎ বিকট শব্দ পান সবুরা বেগম। এরপর সব স্তব্ধ। ছেলের আর কোনো কথা শুনতে পাননি তিনি। বার বার ফোন দিয়েও আর কোনো সাড়া পাননি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ২১ জুলাই রোববার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মো. ফয়েজ। আহত অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
গুলিবিদ্ধ ফয়েজকে হাসপাতালে নিয়েছিলেন তাঁর পরিচিত স্যানিটারি ঠিকাদার মো. কাশেম। সোমবার ফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, 'অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আহত ফয়েজকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক ফয়েজকে মৃত ঘোষণা করেন।' তিনি মাথায় ও ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হন বলে চিকিৎসক কাশেমকে জানিয়েছেন। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁর লাশ লক্ষ্মীপুরের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঠিকাদার কাশেম আরও বলেন, ফয়েজ তাঁর সঙ্গে দুই বছর ধরে কাজ করছিলেন। খুব শান্ত এবং ভদ্র ছেলে ছিল ফয়েজ। দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরি পেতেন। এ টাকায় স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া থাকতেন। ২১ জুলাই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সাইনবোর্ড এলাকার একটি ভবনে কাজ শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। এসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর নুর নাহার ও তাঁর ১৮ মাস বয়সী ছেলে রাফি মাহমুদের ঠাঁই মিলেছে টঙ্গীতে এক স্বজনের বাসায়। মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কাঁদতে কাঁদতে নুর নাহার বলেন, 'ফয়েজকে হারানোর পর পৃথিবীতে আমার আর কোনও আপনজন নেই। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই। এতিমের প্রতি সদয় হয়ে ফয়েজ আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। পৃথিবীতে আমার স্বামীই ছিল আমার আশ্রয় এবং সম্বল।'
'কিন্ত এখন আমার আর কেউ নেই। কে দেখবে আমাকে ? আমাদের ছোট রাফির কি হবে? তাকে তারা গুলি করে মারল। কোন দোষে মারল তাকে, কে জবাব দেবে?' ফয়েজের মৃত্যুর পর আমার আর কোন স্বজন নেই। এখন এ পৃথিবীতে আমি একা। বড়ই একা' - বলছিলেন নুর নাহার।
তিনি বলেন, শ্বশুরবাড়িতে স্বামীকে দাফন করে এসেছি। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও গরিব। তাই এখন টঙ্গীতে এক খালার বাসায় আশ্রয় নিয়েছি। খালা নিজেও অসুস্থ। তার পরিবারও থাকে অর্ধহারে-অনাহারে। জানি না আমি ও আমার ছেলের ভবিষ্যত কী? এরপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নুর নাহার। আর কোন কথা বলতে পারেনি।
ফয়েজের বাবা আলাউদ্দিনও একজন কাঠমিস্ত্রি। তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ফয়েজ সবার বড়। কিন্ত এখন সে নেই। তাই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পরেও বাবা আলাউদ্দিনের কান্না থামছে না।
সোমবার সকালে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, 'আমার ছেলেটা কোন ধরনের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল না। সে ছিল একজন শ্রমিক। দৈনিক হাজিরায় স্যানিটারি ফিটিংসের কাজ করতো। কিন্তু, গুলি করে আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আমার ছেলেতো আর ফিরে আসবে না। কিন্ত ওর বউ আর ছোট নাতিটা কে দেখবে ? বউটাও এতিম। এ পৃথিবীতে তার মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই। বাবা আমার নাতিটাকে আপনারা একটু দেখবেন। এটুকুই অনুরোধ।'
২২ জুলাই ফয়েজের জানাজায় গ্রামের কয়েকশত মানুষ অংশ নেয়। পরে পশ্চিম ঝাউডগি গ্রামে নিজ বাড়ির পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়। কবরের সামনে গিয়ে বাবা আলাউদ্দিন আর মা সবুরা বেগম ছেলের স্মৃতি মনে করে চোখের পানি ফেলছেন।
আলাউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, 'দুটি গুলি আমার ছেলেটারে শেষ করে দিল! ছেলে হত্যার বিচার চাই। কিন্তু, বিচার চাইব কার কাছে? আমি চট্টগ্রাম পোর্টে চাকরি করতাম। সেনা সরকারের সময় এক আন্দোলনে চাকরি হারিয়েছি। এবার আরেক আন্দোলনে ছেলেকে হারালাম।'
ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে এতিম হন ফয়েজের স্ত্রী নুর নাহার বেগম। তার কোন ভাই-বোন নেই। একমাত্র আপনজন ছিলেন স্বামী। কিন্তু, এবার স্বামীকে হারিয়ে অনেকটা বাকরুদ্ধ নুর নাহার। এখন টঙ্গীতে আশ্রয় নিয়েছেন খালা হাজেরা বেগম (৬৫) এর ঘরে। বৃদ্ধ হাজেরা অন্ধ এবং অসুস্থ। তার একমাত্র ছেলেও পঙ্গু। তাই হাজেরা আক্ষেপ করেই বলেন, 'বাবা আমাদের ওপর আল্লাহ এত নির্দয় কেন ? এত কষ্ট নিয়ে আমরা কোথায় যাব? মেয়েটা (নুর নাহার) এবং তার এ ছোট ছেলেটার দিকে তোমরা সবাই দেখ বাবা। আমাদের কেউ নেই।' এরপর হাজেরা বেগমও আর কোনও কথা বলতে পারেনি.........। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে শুধু কান্নার আওয়াজই আসছিল।