দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে শিক্ষার্থীরা
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশজুড়ে হওয়া ছাত্র আন্দোলন ক্রমে একটি গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এর ফলে দীর্ঘ ১৫ বছর দেশ শাসন করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর সরকারের পতন হওয়ার সাথে সাথে উদ্ভুত এই পরিস্থিতিতে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি ভেঙ্গে পড়েছে সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও।
প্রায় সারাদেশে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এর জেরে গত দুইদিন সারা দেশের থানাগুলো ছিল পুলিশশূন্য। এমনকি সড়কেও দেখা মেলেনি কোনো ট্রাফিক পুলিশের।
এমন পরিস্থিতিতে শুধু আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ও দাবি আদায়ের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে দেশকে পুনর্গঠনেও হাত লাগিয়েছে দেশের ছাত্র-জনতা।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাদের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছেন সাধারণ মানুষও।
আমাদের বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো:
বগুড়ার রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষার্থীরা
বগুড়ার শহরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শহরে যানবাহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে গত দুদিন ধরেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা রাস্তায় রয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা মোটরসাইকেল চালকদের হেলমেট পরার এবং রিকশাচালকদের শৃঙ্খলা মেনে চলাচল করতে বিশেষ অনুরোধ করছেন।
বগুড়ার সাতমাথায় ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনকারী শাহ সুলতান কলেজের গণিত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হানমুল হাসানা বলেন, 'বগুড়া শহরে গত দুইদিন হলো পুলিশের কোনো কার্যক্রম নেই। রাস্তাঘাটে সবাই বিক্ষিপ্তভাবে চলাচল করছে। এই পরিস্থিতিতে শহরে শৃঙ্খলা না ফিরলে সব শ্রেণির মানুষ ভোগান্তির শিকার হবে। এই কারণে সাধারণ মানুষের স্বার্থে আমরা মাঠে রয়েছি।'
শহরের সাতমাথায় হামিদুল ইসলাম নামের এক রিকশাচালক বলেন, 'শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামার পর কেউ আর এলোমেলোভাবে যানবাহন চালাচ্ছে না। চাঁদাবাজিও নেই। দীর্ঘ ১৫ বছর পর এই পরিস্থিতি দেখলাম।'
এছাড়া শহরের বিভিন্ন স্থাপনার দেয়ালে শিক্ষার্থীরা রং করছেন। দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন প্রতিবাদী স্লোগান লিখছেন তারা।
খুলনায় সড়কের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরা
খুলনা শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সুব্যবস্থাপনায় কোনো যানজট ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে চলছে পরিবহন ব্যবস্থা।
বুধবার দুপুরের শহরের অন্তত ১০ টি প্রধান প্রধান মোড় ঘুরে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
শিববাড়ি মোড়ে ট্রাফিকের দায়িত্বে থাকা নাহিদ বলেন, 'আমরা হাত ও লাঠির ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছি। কেউ আইন লঙ্ঘন করে ট্রাফিক সিগলান অমান্য করছেন না। চালক যাত্রী সবাই আমাদের সহায়তা করছেন।'
কিছু সড়কে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আনসার সদস্যদেরও ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।
রিয়াদুল নামের এক আনসার সদস্য বলেন, নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক ভালো ভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের পাশাপাশি আমরা কাজ করছি। সবার আন্তরিকতায় শহরের কোথাও যানজট হচ্ছে না।
সিলেটে সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরা
সিলেট নগরীতে আনসার সদস্যদের সাথে শিক্ষার্থীদেরও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। নগর পরিচ্ছন্নতারও কাজ করছেন শিক্ষার্থীরা।
বুধবার বন্দরবাজার এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা শিক্ষার্থী মিরাজ আহমদ বলেন, 'রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। তাই জনদুর্ভোগ লাঘবে আমরাই দায়িত্ব পালন করছি। যতদিন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসবে, ততদিন আমরা এই দায়িত্ব পালন করব।'
এছাড়া মঙ্গল ও বুধবার নগরীর আবর্জনাও পরিষ্কার করেন তারা।
আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থী জানান, 'এখন আমরা যানজট নিরসন ও সড়ক পরিচ্ছন্নতার কাজ করছি।'
সাভারে সড়কের শৃঙ্খলা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে শিক্ষার্থীরা
বুধবার সকালে সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের থানা বাসস্ট্যান্ড, গেন্ডা বাসস্ট্যান্ড, পাকিজা মোড়, সাভার বাসস্ট্যান্ড এবং রেডিও কলোনিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে শিক্ষার্থীদের সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে দেখা যায়।
এছাড়া সড়কের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সড়ক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজও করতে দেখা যায় তাদের।
সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্কাউট সদস্য নাইমুল হাসান অয়ন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-কে বলেন, 'এখন যেহেতু সড়কে ট্রাফিক পুলিশ নেই, তাই স্বাভাবিকভাবেই একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে যেহেতু কিছুটা সময় লাগবে, তাই আপদকালীন এই সময়ে মানুষ যেন নিরাপদে রাস্তা পারাপার হতে পারে এবং যান চলাচল স্বাভাবিক থাকে সেজন্য আমরা কাজ করছি।'
সাভার নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন খান নঈম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেই চিন্তা চেতনা নিয়ে মহৎ এই কাজগুলো শুরু করেছে, আমরা তাদের সাধুবাদ জানাই। একইসাথে তারা আমাদের একটি একটি উপযুক্ত শিক্ষাও দিল, কারণ রাস্তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা পৌরসভার কাজ, কিন্তু আমরা কখনো দেখিনি পৌরসভা এভাবে তাদের দায়িত্ব কখনো পালন করতে পেরেছে।'
কুমিল্লায় সড়কে শৃঙ্খলায় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী, করছেন বাজার মনিটরিংও
কুমিল্লায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করছে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। এর মধ্যে কুমিল্লা নগরীতে কাজ করছে পাঁচ শতাধিক। তারা বাজার মনিটরিংয়ের কাজও করছেন।
বুধবার নগরীর টমছমব্রিজ, কান্দিরপাড়, রাজগঞ্জ, চকবাজার, রানির বাজার, রেসকোর্স, শাসনগাছা এলাকায় গিয়ে এসব চিত্র দেখা যায়।
সড়ক ব্যবস্থাপনা ফেরাতে কোনো কোনো শিক্ষার্থী মাইকিং করছেন। তারা জনসাধারণকে ফুটপাত ব্যবহারের অনুরোধ করছেন। কোনো শিক্ষার্থী হাতে লাঠি, কেউ মুখে বাঁশি দিয়ে সংকেত দিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজ করছেন।
কান্দিরপাড়ে ট্রাফিকের কাজ করা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলেন, 'এ কাজ করতে তার বেশ ভালো লাগছে। পরিবার থেকে বাবা-মা তাকে উৎসাহিত করেছেন।'
বিবির বাজার এলাকার সিএনজি অটোরিকশা চালক হুমায়ুন কবির বলেন, 'কোথাও যানজট, চাঁদাবাজি নেই। এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম।'
ফরিদপুরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতায় ছাত্ররা
গত তিন দিন ধরে জেলার কোন থানাতেই নেই পুলিশের উপস্থিতি। একই সাথে শহরগুলোতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণে যে ট্রাফিক তারাও নেই। এ পরিস্থিতিতে মাঠে নেমেছেন ছাত্র- ছাত্রীরা।
কারো হাতে বাঁশি, কারো হাতে লাঠি। আবার কেউ হাতের ইশারায় করছেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ। কোথাও আবার ঝাড়ু ও পলিথিন ব্যাগ হাতে নিয়ে করছেন রাস্তা পরিষ্কারের কাজ।
বুধবার শহরের ভাঙ্গা রাস্তার মোড়, জনতা ব্যাংকের মোড়, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে, রাজবাড়ী রাস্তার মোড় এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
এসময় রীতিমতো যানবাহনের দীর্ঘ লাইনকে তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন সঠিকভাবে। কাউকে বুঝিয়ে কাউকে সহযোগিতা করে তারা পার করে দিচ্ছেন রাস্তা।
এ সময় ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের কর্মী মো. মোবারক জানান, সারা শহর জুড়ে ছাত্রদের সাথে তারা ট্রাফিকসহ বিভিন্ন ব্যবস্থাপনায় কাজ করছেন। যাতে কোনোভাবে শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থায় চাপ না থাকে সেই ব্যবস্থাই তারা করছেন।
কক্সবাজারে যানজট নিরসন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় শিক্ষার্থীরা
কক্সবাজার শহরের কলাতলী, বাজারঘাটা, গুনগাছতলা মোড়সহ জেলা শহরের প্রধান সড়কে বুধবার সকাল থেকে ট্রাফিকের ভূমিকা পালন করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এছাড়া কক্সবাজার শহরের সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কক্সবাজার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার এবং প্রধান সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ময়লা-আবর্জনাও পরিষ্কার করেছে তারা। একই সঙ্গে স্কুল দুইটির গেইটে থাকা পোস্টার সরানো, দেয়াল লিখন মুছে দিয়ে রঙ করতেও দেখা গেছে তাদের।
কক্সবাজার সিটি কলেজের শিক্ষার্থী রিয়াজুল শামশু মিয়া জানান, যানজট নিরসনে নিজের ইচ্ছায় সকাল থেকে অন্যান্যদের সাথে সড়কে কাজ করছেনে তিনি। সড়কে চলাচলকারী যানবাহন চালকরাও তাদের নিদের্শনা মেনে চলছেন। তাই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে না।
অন্যদিকে, দলবদ্ধ হয়ে কক্সবাজার শহরের মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারেও পাহারা দিয়েছেন তারা।
কক্সবাজার সার্বজনীন শ্রী শ্রী কৃষ্ণানন্দধাম মন্দিরের সভাপতি দুলাল চন্দ্র দে বলেন, 'শিক্ষার্থীরা রাতে বিভিন্ন মন্দির পাহারা দিচ্ছে। নিয়মিত তারা যোগাযোগ করছে। শুরুর দিকে ভয়, আতঙ্ক থাকলেও এ পর্যন্ত কক্সবাজারে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।'
চট্টগ্রামে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে দ্বিতীয় দিনের মতো মাঠে শিক্ষার্থীরা
চট্টগ্রামে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কাজে দ্বিতীয় দিনের মতো মাঠে নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। শহরে কোন ট্রাফিক পুলিশ না থাকায় মঙ্গলবার থেকে টানা সড়কে যানজট নিরসনে দায়িত্ব পালন করছে শিক্ষার্থীরা।
তারা শুধু যানজট নিরাসনেই কাজ করছে না, পথচারীদের রাস্তা পারাপারের নিয়মনীতি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করছে। শিক্ষার্থীদের এমন মহৎ কাজকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শহরবাসী।