সড়ক-ফুটপাতের চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে নাকি যাচ্ছে নতুন গোষ্ঠীর হাতে?
কৃষক পর্যায়ের সবজির পাইকারি মূল্যের সাথে রাজধানীর খুচরা বাজারে দামের পার্থক্য থাকে অন্তত কয়েকগুণ। কখনো কখনো তা ১০গুণও ছাড়িয়ে যায়। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে পরিবহন ও পাইকারি বাজারের কয়েক স্তরের চাঁদাবাজি।
এছাড়া, রাজধানীর ফুটপাতে প্রায় ৩ লাখ দোকান থেকে অবৈধভাবে চাঁদা নিয়ে আসছিলেন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যরা।
তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কারণে এসব সিন্ডিকেট ভেঙ্গে গেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু স্থানে নতুন কয়েকটি চক্র পুনরায় সক্রিয় হচ্ছে বলে জানা গেছে। যদিও শিক্ষার্থী ও সেনাবাহিনীর মনিটরিংয়ের কারণে স্বস্তিতে রয়েছেন ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিকরা।
রাজধানীতে সবজির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজার। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, ঢাকার প্রায় ৫৮ শতাংশ সবজি এই বাজারে কেনাবেচা হয়। এখানে সবজি এনে বিক্রি করতে হলে কয়েক ধাপে চাঁদা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। আর এর প্রভাব পড়ে সবজির দামে।
সাভার থেকে নিয়মিত কারওয়ান বাজারে সবজি নিয়ে আসেন রুহুল আমিন। তাকে কারওয়ান বাজার আসতে হলে গাবতলী, বেড়িবাঁধসহ কয়েক স্থানে চাঁদা দিতে হতো। এর পাশাপাশি মাসিক অন্তত ১,০০০ টাকা হারে ট্রাফিক পুলিশের নামে চাঁদা দিতে হতো। আবার কারওয়ানবাজারে গাড়ি নামালে স্থানভেদে চাঁদা দিতে হতো ৭০-১৫০ টাকা। গাড়ির আকারভেদে তা কোনো কোনো সময় বেশি হতো।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "পথে এখন আর কাউকে চাঁদা দেওয়া লাগছে না। কারওয়ান বাজারে কয়েকদিন চাঁদা দেওয়া লাগেনি। তবে গত বুধবার টাকা নিয়েছে। আবার বৃহস্পতিবারের পর থেকে চাঁদা দেওয়া লাগেনি। পথে চাঁদা না দিলে চালকদের মারধর, গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটতো। চাঁদা না থাকলে তো আমাদের অনেক উপকার হয়।"
গত কয়েকদিন কারওয়ানবাজার ঘুরে ট্রাক চালক ও পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী অন্তত ১৫ জনের সাথে সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে কারওয়ান বাজারের চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করতো যুবলীগ নেতা লোকমান। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে। যদিও নতুন কয়েকটি চক্র চাঁদার জন্য এসে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মনিটরিংয়ের কারণে তা আবারও বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তারা।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী মো. বশির হোসেন টিবিএসকে বলেন, "সবজি এনে যে জায়গায় রাখি এরজন্য দিনে জায়গাভেদে অন্তত ৩০০-৫০০ টাকা দিতে হতো। আপাতত কেউ এটা নিচ্ছে না, বন্ধ আছে। শিক্ষার্থীরা নাকি বাজারে এসে তদারকি করছে। তবে কতদিন বন্ধ থাকে, তা বলতে পারছি না। এখানে চাঁদা না দেওয়া লাগলে তো দাম কিছুটা কমবেই।"
মুন্সিগঞ্চ থেকে আলু নিয়ে আসা ট্রাক চালক ইকবাল হোসেন বলেন, "পথেই আমাদের ট্রাকের জন্য ১,০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এখন কোথাও চাঁদা দেওয়া লাগছে না। কারওয়ান বাজারে ডাক দেওয়া লাগতো ১৫০ টাকা।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুইজন ব্যবসায়ী জানান, নতুন করে চাঁদাবাজদের আনাগোনা বাড়ছে। কেউ কেউ যুবদলের পরিচয় দিচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের শক্ত মনিটরিংয়ের কারণে কেউ সাহস করছে না।
কারওয়ান বাজারে তদারকির জন্য ১৫ জনের একটি টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিক্ষার্থী শাখাওয়াত হোসেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমাদের কয়েকটি টিম রয়েছে। সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি। ওইদিন একজন ব্যবসায়ী আমাদের কাছে দুইজন চাঁদাবাজের বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন। আমরা তখন সেনাবাহিনীর সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা শুনছি নতুনভাবে কেউ কেউ চাঁদা তুলতে আসছেন। তবে আমরা শক্তভাবে মনিটরিং করছি।"
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের বিক্রেতা মো. মামুন হোসেন টিবিএসকে বলেন, "বিএনপির কয়েকজন এসে দোকানে দোকানে বলে গিয়েছে, কেউ যদি তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদা তুলতে আসে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। শিক্ষার্থীরাও তদারকি করছেন।"
শাহজাদপুর, গুলশান, মহাখালী, গুলিস্তান, মগবাজারসহ রাজধানীর অন্যান্য স্থানেও প্রায় একই চিত্র। শাহজাদপুরে গুলশান লেকের পাশে অনেকগুলো দোকান। এসব দোকান থেকে দিনে ৫০০-৫৫০ টাকা ভাড়া আদায় করা হতো। এর বাইরেও ছিল কয়েক ধাপের চাঁদা। তবে এখন চাঁদা দিতে হচ্ছে না। দিনে অন্তত ৪০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হতো ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা থেকে। তারাও এখন চাঁদা থেকে মুক্ত রয়েছেন।
মহাখালীতে ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে ২০০-২৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হতো। ফল বিক্রেতা মোজাম্মেল হোসেন টিবিএসকে বলেন, "কয়েক স্তরে চাঁদা দিতে হতো। এখন দেওয়া লাগে না। সেনাবাহিনী এসে নিষেধ করে গেছে।"
হকার্স সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ ফুটপাথ ও ভাসমান হকার রয়েছে রাজধানীতে। এসব হকারদের থেকে গড়ে ১৫০-২০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হতো। লাইনম্যান, পুলিশ ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিরা এসব চাঁদা তুলতেন।
তবে এ চাঁদাবাজি কতদিন বন্ধ থাকে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন এসব ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ হকার ঐক্য পরিষদের সভাপতি মুরশিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "হকারদের থেকে নিয়মিত একটি চাঁদা তুলে সরকারিভাবে স্থায়ী পুনর্বাসন করতে হবে। সরকারিভাবে উদ্যোগ না নিলে আবার নতুন চাঁদাবাজ তৈরি হবে। এরা হকারদের রাজনৈতিকভাবে আগে যেমন ব্যবহার করতো আবারও করবে। এজন্য অন্তত পাঁচ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।"
সার্বিক বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, "চাঁদাবাজি বন্ধ হবে কি–না জানি না। কারণ নতুন গ্রুপ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, তারা হয়তো সময় নিচ্ছে। এটা শক্তভাবে দমন করতে হবে। তাহলে জিনিসপত্রের দাম অনেক কমে যাবে। এখনই সময় পরিবর্তনের।"