আছাদুজ্জামান মিয়ার তথ্য ফাঁস: জিএমপির এডিসি জিসানুলের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার
গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জিসানুল হকের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সোমবার (১৯ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেছেন সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত ১৯ জুন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে জিসানুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। পরে গত ২৩ জুন জিসানুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের শৃঙ্খলা শাখা।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর গত ১২ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পোস্ট দেন জাওয়াদ নির্ঝর নামের একজন প্রবাসী।
সেই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে তিনি টেলিগ্রামের একটি লিংকও শেয়ার করেন। সেখানে আছাদুজ্জামান মিয়ার 'ইএসএএফ' ফরম তুলে দেওয়া হয়। ইএসএএফ ফরম হলো ইলেকট্রনিক সাবস্ক্রাইবার অ্যাপলিকেশন ফরম, যা মূলত মোবাইল গ্রাহকরা পূরণ করে থাকেন। এই ফরমে একজন ফোন গ্রাহকের নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, আঙুলের ছাপসহ বিস্তারিত তথ্য থাকে।
সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া শেখ হাসিনার সরকারের আশির্বাদপুষ্ট হওয়ায় তখন তাকে রক্ষায় এগিয়ে আসে পুলিশ সদর দপ্তর। তার ব্যক্তিগত তথ্য কীভাবে অনলাইনে গেল, তা পুলিশের উচ্চপর্যায় থেকে তদন্ত করতে বলা হয়।
সূত্র থেকে আরো জানা যায়, গাজীপুরের উপ কমিশনার পদের এক কর্মকর্তা এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেন। প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, গাজীপুর মহানগর পুলিশের 'বৈধ আড়ি পাতা শাখা' (এলআইসি) থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছিল অনলাইনে প্রকাশিত ওই তথ্য। গাজীপুর মহানগর পুলিশের এলআইসি শাখার একজন এএসআই ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার থেকে এটি ডাউনলোড করেছেন।
তদন্তে বেরিয়ে আসে, গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার জিসান গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আছাদুজ্জামানের মোবাইল ফোনের তথ্য চেয়ে বৈধ এলআইসি শাখার এক এসআইকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দেন। সেই বার্তার ভিত্তিতে তিনি অন্য একজন এএসআইকে সেটা ডাউনলোড করতে বলেন। পরে সেটা কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়।
তদন্তে আরো দেখা যায়, অনলাইনে প্রকাশিত ফরমটি হুবহু সেই ফরম। এ ঘটনায় একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জিসানসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করেন। পরে গাজীপুর মহানগর পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জিসানকে সাময়িক বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জিসানের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, 'তার সাময়িক বরখাস্তকাল কর্তব্যরতকাল হিসেবে গণ্য হবে। তিনি বিধি মোতাবেক বকেয়া বেতন-ভাতাদি প্রাপ্য হবেন। জনস্বার্থে জারি করা এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।'
সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম।
তিনি জানিয়েছেন, জিসানুল হককে আজ মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) জিএমপিতে যোগদান করতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত জুনে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পত্তি অর্জন নিয়ে আলোচনায় ডিমএপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে একাধিক খবরও প্রকাশিত হয়।
আছাদুজ্জামানের সম্পদের বিবরণী-সংক্রান্ত কিছু নথি টিবিএসের হাতে এসেছিল। তবে তাৎক্ষণিকভাবে সবগুলো নথির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
সংবাদমাধ্যমের খবর ও টিবিএসের কাছে আসা নথিগুলোর তথ্যানুযায়ী, পূর্বাচলের নিউ টাউনের ১ নম্বর সেক্টরের ৪০৬/বি রোডে ১০ কাঠা জমি রয়েছে আছাদুজ্জামান মিয়ার নামে, যার মূল্য এক কোটি টাকারও বেশি। এছাড়া আফতাবনগর ৩ নম্বর সেক্টরের এইচ ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ৩৬ নম্বর প্লটে তার ২১ কাঠা জমি আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তাছাড়া আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকের লেন-১-এ ১৬৬ ও ১৬৭ নম্বরে একটি ছয়তলা আলিশান বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। প্রতিবেদন ও নথি অনুযায়ী, বর্তমানে বাড়িটি স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সম্পত্তির বাজারমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
আফরোজা জামানের নামে ইস্কাটন গার্ডেন ১৩/এ প্রিয়নীড়েও একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে তিনি বিশেষ কোটায় রাজউক থেকে একটি প্লট বরাদ্দ পান। অথচ রাজউকের নীতিমালা অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্লট বরাদ্দ পাওয়ার সুযোগ নেই।
নথি অনুযায়ী, আফরোজা জামানের নামে গাজীপুর, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জমির সন্ধান মিলেছে। গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় তার নামে ১৩৭ শতাংশ জমি রয়েছে, যা কেনা হয়েছে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে।
২০২০ সালে একই এলাকার সাহারা মৌজায় ১৫ কাঠা জমি কেনেন তিনি। এছাড়া ২০১৮ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইল-কায়েতপাড়া মৌজায় ৬০.৬০ একর জমি কেনেন।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নিকুঞ্জ-১-এর ৮/এ রোডে আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহদীনের নামে একটি বাড়ি রয়েছে, যার মূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি। তার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামে সিদ্ধেশ্বরী রূপায়ন স্বপ্ন নিলয় ৫৫/১-এর বহুতল ভবনে ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে।
এছাড়া বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় অন্তত দুটি কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামান উভয় কোম্পানির অংশীদার এবং মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আসাদুজ্জামান ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে রাজধানীর রুট পারমিট কমিটির প্রধান ছিলেন। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন ও টিবিএসের কাছে আসা নথি অনুসারে, তার আমলে মৌমিতা পরিবহনকে রুট পারমিট দেওয়া হয়।
এই মৌমিতা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান হারিসুর রহমান সোহান; তিনি আফরোজা জামানের সৎ ভাই। একসময় তিনি লেবার ভিসায় সৌদি আরবে গেলেও পরে বাংলাদেশে ফিরে ব্যবসা শুরু করেন।
এছাড়া আফরোজা জামান শেফার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান। এ কোম্পানির পরিচালক আসাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে এসেছে।
সে সময় বক্তব্যের জন্য আছাদুজ্জামান মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে আছাদুজ্জামান এর আগে সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, তিনি বৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সম্পদ কিনেছেন এবং বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করতে পরিকল্পিতভাবে এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন তিনি।