ভুলুয়া নদীর দখল ও অব্যবস্থাপনা: পানিবন্দি লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর ৩ লাখ মানুষ
লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ভুলুয়া নদীর অব্যবস্থাপনা ও দখলের কারণে প্রায় তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। টানা ৩৩ দিন ধরে নদীর পানি না নামার কারণে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির স্বীকার স্থানীয় বাসিন্দারা।
ভুলুয়া নদী নোয়াখালী থেকে শুরু হয়ে লক্ষ্মীপুর জেলার মাঝ দিয়ে দক্ষিণে গিয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। নদীর দুই তীরে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার অন্তত ২০টি ইউনিয়ন অবস্থিত। নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ ইউনিয়নগুলোর মানুষ রয়েছেন চরম দুর্ভোগে।
নদীর আশপাশের বাসিন্দারা জানান, প্রতিদিনই পানির পরিমাণ বাড়ছে। হাজার হাজার একর জমিতে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। পুকুরের মাছও নষ্ট হয়েছে। বাসিন্দারা এখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে থাকলেও পুরো এলাকায় শুকনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ভুলুয়া নদের পশ্চিম এবং দক্ষিণ পাশে তোরাবগঞ্জ-হাজীগঞ্জ সড়কের দক্ষিণপাশে মেঘনার তীরের জমিগুলোতে তেমন পানি নেই। তবে সড়কের পূর্ব ও উত্তর পাশে ভুলুয়ার তীরের সকল বাড়িতে শুধু পানি আর পানি।
তারা রান্না করতে পারছেন না এবং অনেকেই ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। স্থানীয়রা জানান, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তাদের জীবন আরও বিপন্ন হতে পারে।
ভুলুয়া নদের চর কাদিরা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে স্থানীয় বাসিন্দা রহিম মাঝি জানান, বিগত কয়েক বছরে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে স্থানীয় নেতারা যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ, মাছের ঘের তৈরি এবং বসতি স্থাপন করেছেন। এসব কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় সমস্যা হয়নি, কিন্তু এবছর টানা দেড় মাসের বৃষ্টিতে পুরো ভুলুয়া এলাকা ডুবে গেছে।
চর কাদিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মো. হারুন বলেন, "ভুলুয়া নদের পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার ইউনিয়নের ৯০ ভাগ এলাকা ডুবে গেছে। আমরা প্রায় ১ হাজার লোক মিলে বাঁধ কাটার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি। পরে আমরা রামগতি উপজেলায় গিয়ে বিক্ষোভ করি এবং প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি জমা দেই। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তবে প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে।"
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বলেন, চর পোড়াগাছার ১ নম্বর ওয়ার্ডে একটি ব্রিজ এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যার নীচু স্প্যান পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিচ্ছে। এই ব্রিজও ভুলুয়া নদের পানি প্রবাহ বন্ধ করার জন্য দায়ী। তবে সব মিলিয়ে এখন আমরা বন্যা আক্রান্ত মানুষদের নিরাপত্তায় কাজ করছি। এছাড়া আমাদের আর কিছু করার সুযোগ নেই।
প্রভাবশালীদের দখলদারিত্ব
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তি ভুলুয়া নদীর জমি দখল করে বিক্রি করেছেন এবং শতাধিক বসতি নির্মাণ করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা রহমান খোনার বলেন, 'সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে মেঘনা নদীর কাছাকাছি রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড আজাদনগর স্ট্রীল ব্রিজের পূর্ব দিকে ও কোডেক বাজার এলাকায়। এখানে কয়েকজন প্রভাবশালী নদীর জমি স্থানীয়দের নিকট বিক্রি করে দিয়েছে ।
তারা প্রায় শতাধিক বসতি নির্মাণ করেছে। চারটি বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের ও মুরগির খামার দিয়েছে। এর পাশেই ইটভাটার জন্য রাস্তা তৈরি করেছে। ৭৬ কিলোমিটার ভুলুয়া সেখানে গিয়ে ভুলুয়া পুরোপুরি বন্ধ। এখন কোনোভাবেই মেঘনাতে পানি যেতে পারছে না'।
স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, চর আলগী ইউনিয়নের স্লুইচ গেটও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে বাজার বসিয়েছে, যার ফলে নদীর বিকল্প পথও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন নোয়াখালী হয়ে যে পানি ভুলুয়াতে আসে তা মেঘনা নদীতে যাওয়ার কোনো পথই আর নেই।
নদীর পানি না নামার কারণে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার প্রায় ২০টি ইউনিয়নের অন্তত ৩ লাখ বাসিন্দা পানিবন্দি। বন্যার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে তারা। এ পানি কখন, কীভাবে নামবে সে চিন্তায় ঘুম হারাম বাসিন্দাদের।
স্থানীয় মমিন পাটোয়ারি বলেন, রামগতির পোড়াগাছার চেয়ারম্যান নুরুল আমিন এবং আজাদনগরের কামাল পাশার ভাতিজা সমীর, কামাল মাঝি নদীতে বাঁধ দিয়ে জমি বিক্রি করে বসতি স্থাপন করেছে এবং পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
নদীর দখলদারিত্বের বিষয়ে চেয়ারম্যান নুরুল আমিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, "স্থানীয় কামাল পাশার ভাতিজা সমীর নদী দখল করে বিক্রি করে বসতি তৈরি করেছে, মাছের ঘের দিয়েছে, মুরগি ফার্ম করেছে। তবে তারা প্রভাবশালী হওয়ায় আমি সেগুলো বন্ধ করতে পারিনি। সে কারণে আমার বিরুদ্ধে নদী দখলের উল্টো অভিযোগ আনা হয়েছে, যা মোটেও সত্য নয়।"
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, স্থানীয়রা বিক্ষোভ করে তার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু বাঁধ কেটে দেয়া হয়েছে। বাকিগুলো পানির নিচে হওয়ায় এখন আর কাটা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, "এ নদের কিছু এলাকার কাজ করতে হলে নোয়াখালীর প্রশাসনের সহযোগিতা দরকার, কারণ কিছু এলাকা নোয়াখালীর মধ্যে পড়ে। সে কারণে লক্ষ্মীপুর প্রশাসনের পক্ষে তা করা সম্ভব না। তবে আমরা চেষ্টা করছি।"
উল্লেখ্য, পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার মধ্য দিয়ে মেঘনা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত ভুলুয়া নদের লক্ষ্মীপুর অংশের দৈর্ঘ্য ৭৬ কিলোমিটার। জলাধারটি আগে গড়ে ৩০০ মিটার চওড়া হলেও এখন কমে গড়ে ১০০ মিটার হয়ে গেছে।