যুক্তরাজ্যে পোস্টিং নিয়ে চাকরি ছাড়লেন সোনালী ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা
সোনালী ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি সোনালী বাংলাদেশ ইউকে লিমিটেডে কাজ করার সুবাদে ৪ বছর আগে পোস্টিং নিয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান ব্যাংকটির ২ কর্মকর্তা। সেখানে গিয়ে সে দেশের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস (স্থায়ী বাসিন্দার মর্যাদা) লাভের পর এক কর্মকর্তা চলতি বছরের এপ্রিলে এবং আরেক কর্মকর্তা জুনে সোনালী ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
এরপরেও, ওই দুই কর্মকর্তাকে এখন একই শাখায় বিদেশি কর্মী হিসাবে পুনরায় নিযুক্ত করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমের কাছে জুলাই মাসের প্রথম দিকে এসব নিয়োগের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। তবে সোনালী ব্যাংক এ ব্যাপারে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
সোনালী ব্যাংকের অন্যান্য বিদেশি শাখা ও প্রতিনিধি অফিসে কর্মরত পদায়ন ও নিয়োগ নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, এসব কারণে ব্যাংকের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের শতভাগ মালিকানাধীন একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি হলো সোনালী ব্যাংলাদেশ ইউকে লিমিটেড। ঢাকা থেকেই প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ মোট পাঁচজন কর্মকর্তাকে ঢাকা থেকে পাঠানো হয়। বাকি কর্মীরা যুক্তরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা। এর পরিচালনা পর্ষদও ঢাকায় গঠিত।
সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত মার্চ মাসে সোনালী ব্যাংলাদেশ ইউকে লিমিটেডে দায়িত্বরত সোনালী ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) ফারজানা হক যুক্তরাজ্য থেকে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আবেদন পাঠান। গত ১ এপ্রিল থেকে তার ইস্তফা কার্যকর করেছে সোনালী ব্যাংক।
একইভাবে সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার সুজা উদ্দিন আল রেজা গত ২৬ জুন যক্তরাজ্যে চাকরি থেকে ইস্তফা চেয়ে আবেদন করেন। ১ জুলাই থেকে তাকে ইস্তফা দেওয়া হয়েছে।
এই দুজন কর্মকর্তাকে ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্যে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল।
সূত্র বলছে, উভয়ই এখন যুক্তরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার পরেও ব্যাংকটিতে একই পদে নিযুক্ত আছেন।
সোনালী ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা থেকে যাদেরকে যুক্তরাজ্যে পোস্টিং দেওয়া হয় দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে, এসব কর্মকর্তারা পরিবার অর্থাৎ, স্বামী বা স্ত্রী ও সন্তানদের ওই দেশে নিয়ে যেতে পারেন। কর্মকর্তার যাওয়া, থাকার খরচ বহন করে সোনালী ব্যাংক। কমপক্ষে তিন বছরের জন্য তাদেরকে যুক্তরাজ্যে পোস্টিং দেওয়া হয়ে থাকে।
সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "পোস্টিংয়ের সুযোগে যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ নিচ্ছেন কোনো কোনো কর্মকর্তা— এটি অনৈতিক।"
তিনি বলেন, সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল এই কর্মকর্তারা আবার পরে বিদেশি কর্মী হিসেবে একই জায়গায় পুনরায় নিয়োগ পাচ্ছেন।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, "সোনালী ব্যাংকের অন্যান্য বিদেশি শাখায়ও যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী পোস্টিং হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পছন্দের কর্মকর্তারা পোস্টিং পাচ্ছেন।"
"যেকারণে ওইসব কর্মকর্তা ব্যাংকের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের সুবিধা বেশি প্রাধান্য দেন। এতে ব্যাংক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে," যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জেনারেল ম্যানেজার (পারসোনাল ডিভিশন) মো. সাফায়েত হোসেন পাটোয়ারী টিবিএসকে বলেন, "যেকোনো কর্মীই চাকরি ছাড়তে পারেন। চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী কোনো আপত্তি না থাকলে চাকরি ছাড়ার আবেদন গ্রহণও করতে হবে।"
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "তবে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় সোনালী বাংলাদেশ ইউকে লিমিটেডে পোস্টিং বা নিয়োগ বিধিমালায় কিছু পরিবর্তন আনার কথা ভাবা হচ্ছে।"
সোনালী বাংলাদেশ (ইউকে) লিমিটেড ছাড়াও সোনালী ব্যাংকের ভারতের কলকাতা ও শিলিগুড়িতে শাখা রয়েছে। এছাড়া প্রতিনিধি অফিস রয়েছে জেদ্দা ও কুয়েতে। এর আগেও শাখা ও প্রতিনিধি অফিসে পোস্টিংয়ে নিয়ম না মানার অভিযোগ করেন এই কর্মকর্তা।
তিনি জানান, "ব্যাংকের একজন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার দুই ভাগ্নেকে জেদ্দা ও যুক্তরাজ্যে যোগ্যতা না থাকার পরও পদায়ন করেন । বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালককে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বললেও উনি ব্যবস্থা না নিয়ে তাদেরকে স্বপদে বিদেশে বহাল রেখেছেন।"
অতিরিক্ত লোকবল, আর্থিক চাপ
সূত্র জানায়, বছরের পর বছর আর্থিক ক্ষতির কারণে সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডকে সোনালী বাংলাদেশ ইউকে লিমিটেডে রূপান্তর করা হয়। লন্ডনে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি সেখানে থাকা বাংলাদেশিদের বাণিজ্য-অর্থ সহায়তা প্রদান করে।
জানা গেছে, সোনালী বাংলাদেশ (ইউকে) লিমিটেড মুলধন ঘাটতিতে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না। যেকারণে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ৩.৫০ শতাংশ সুদে ৫৮.৭৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে রেখেছে। ২০২৩ সালে সহায়ক এই প্রতিষ্ঠান লাভ করে ১.৯ মিলিয়ন পাউন্ড।
তবে সামগ্রিকভাবে কর্মকর্তাদের দক্ষতার ঘাটতি, দায়িত্বপালনে আন্তরিকতার অভাবে বিদেশে থাকা এই সাবসিডিয়ারি কোম্পানি সোনালী ব্যাংকের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।
সোনালী ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, ২০০১ সালে ২৪ জন কর্মী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেড। এরপর থেকেই ক্রমাগত লোকসান হতে থাকায় এটি বন্ধ হয়ে যায় এবং এর পরিবর্তে ২০২২ সালের আগস্টে চালু হয় সোনালী বাংলাদেশ ইউকে লিমিটেড।
এমন ধারাবাহিক লোকসানের একটি অন্যতম কারণ হলো অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের কাঠামো— যা অবশ্য পরবর্তীতেও বহাল থাকে। নতুন প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহ বা বিনিয়োগে জড়িত না থাকলেও বিদেশি বিল এবং বন্ড সমন্বয় করে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে, ২৪ জন কর্মী সেখানে কাজ করছেন। এরমধ্যে ঢাকা থেকে অতিরিক্ত দুই কর্মকর্তাকে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে গত ১৩ মে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দুই নতুন কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎকার (ভাইভা) নিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সোনালী ব্যাংকের বিদেশি শাখা ও প্রতিনিধি অফিসগুলো ব্যাংকিং কার্যক্রমের চেয়ে তাদের সফরের সময় ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা, ঢাকা থেকে আগত বোর্ড সদস্য এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রটোকল সেবা প্রদানে বেশি ব্যস্ত থাকে।
এছাড়া, সোনালী ব্যাংক ইউকেতে সোনালী পে নামে আরেকটি এনটিটি রয়েছে, যেটি ২০২২ সালে রেমিট্যান্স হাউস হিসাবে লাইসেন্স পেয়েছিল।
ওই কোম্পানিতে ৫ জন নিয়োগ পেয়েছেন এবং কোম্পানিটি লোকসানের ওপরেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বেতন এবং অন্যান্য খরচ বাবদ কোম্পানির ১ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রাথমিক মূলধন ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। ফলে সোনালী পে এখন অতিরিক্ত আরও ১ মিলিয়ন পাউন্ড মূলধন পেতে অনুরোধ জানিয়েছে।
এদিকে, সোনালী ব্যাংক এই অতিরিক্ত অর্থায়নের অনুমোদন নিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে বলেও সূত্র জানায়।