ডিসি নিয়োগ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বিশৃঙ্খলা চরমে
নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ নিয়ে জনপ্রশাসনে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
মঙ্গল ও বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) পরপর দুইদিন সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দপ্তরে ঢুকে তর্কে জড়িয়ে পড়ছেন।
সূত্র জানিয়েছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চিৎকার চেঁচামেচি ও হুইহল্লা করেছেন তারা দপ্তরের বাইরে দাঁড়িয়ে।
সম্প্রতি দুটি আদেশে সরকার ৫৯ জেলায় ডিসি নিয়োগ করেছে। কিন্তু বুধবার লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, শরীয়তপুর, দিনাজপুর ও রাজবাড়ী জেলার ডিসির নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।
এসব জেলায় আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে নতুন করে জেলা প্রশাসকের নিয়োগ করা হবে বলে বুধবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান।
যেসব কর্মকর্তাকে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের বড় অংশ দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাড়তি সুবিধাভোগী বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যে তাদের নিয়োগ নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
নিজেদের 'বঞ্চিত' দাবি করে ৫৯ জেলার ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে নতুন করে নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। বুধবার তারা বিকাল পাঁচটার মধ্যে এ দাবি বাস্তবায়নের আল্টিমেটাম দেন।
উল্লেখ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
কর্মকর্তাদের এই আচরণকে 'অশোভন ও অনাকাঙ্ক্ষিত' বলেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান।
গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষুদ্ধ কর্মকর্তাদের কিছু অভিযোগ বাস্তব। সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে ডিসি ফিট লিস্ট তৈরির স্ট্যান্ডিং বাছাই কমিটি আট জেলার ডিসির নিয়োগ বাতিল করেছে।
মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা উপসচিব মর্যাদার কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কে এম আলী আযমের রুমে তর্কে জড়িয়ে পড়েন।
মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত এই রুম থেকে মাঠ প্রশাসনের (ডিসি ও ইউএনও) নিয়োগ ও বদলি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
তর্কের সময় কয়েকজন কর্মকর্তাকে ধাক্কাধাক্কি করতে দেখা যায়। তবে এক নারী কর্মকর্তাসহ কয়েকজন ঘটনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।
একপর্যায়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় তলায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্য অবস্থান নেন। এরপরও বিকেল ৪টা পর্যন্ত দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করেন কর্মকর্তারা।
এরপর একই ভবনের চতুর্থ তলায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের রুমের সামনে অবস্থান নেন ক্ষুব্ধ উপসচিবরা।
বিকেল ৫টার দিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে কথা বলার পর সন্ধ্যায় সোয়া ৬টার দিকে রুম থেকে উপসচিবরা বেরিয়ে আসেন।
কর্মকর্তারা কেন এমন আচরণ করেছেন, সেটা দেখার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেনকে প্রধান করে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
এই কমিটি আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই পদোন্নতি, ভালো পোস্টিং, নিয়োগ ও জোর করে পদত্যাগ করানো নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই সরকারের কোনো না কোনো দপ্তরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে।
এরমধ্যে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু খোদ সচিবলায়েই বিক্ষোভের ঘটনা ঘটছে বেশি। সর্বশেষ ডিসি নিয়োগ নিয়ে যা ঘটেছে, এটি জনপ্রশাসনে বিরল ঘটনা।
মন্ত্রণালয়ে স্থায়ী চাকরি করেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের চাকরিজীবনে এমন ঘটনা এই প্রথম দেখলেন।
একজন কর্মকর্তা বলেন, সাবেক সরকারের পতনের পর হঠাৎ করে যেভাবে পদোন্নতি, নিয়োগ ও পদায়ন করা হয়েছে, সেটাও কর্মকর্তাদের এই ঘটনা ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সরকারও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়োগ দিয়ে তা বাতিল করেছে। ফলে এখন নিয়োগ বাতিলের দাবি সহজে তোলা যাচ্ছে।
সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান বলেন, পদায়নকৃত যেসব ডিসির বিরুদ্ধে যৌক্তিক অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেগুলো বিবেচনায করে আট জেলার ডিসি নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জনপ্রশাসনে নিয়োগ, পদায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। কোনো জায়গায় যদি সমস্যা থাকে যেটা ভ্যালিড, ক্লাসিফাইড সেটা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। একদিনের ডিসি, একদিনের কমিশনার, একদিনের সচিব—এটা নতুন কিছু না।
এছাড়া কাজে সমন্বয় সৃষ্টির লক্ষ্যে চার জেলায় ডিসি রদবদল করা হয়েছে। টাঙ্গাইলের ডিসিকে দেওয়া হয়েছে পঞ্চগড়ে, নীলফামারীর ডিসিকে টাঙ্গাইল, নাটোরের ডিসিকে লক্ষ্মীপুরে এবং পঞ্চগড়ের ডিসিকে নীলফামারীর ডিসি করা হয়েছে।
বিক্ষোভরত কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, যাদের ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী। গত সরকারের অনুগত থাকায় তারা ভালো জায়গায় চাকরি করেছেন।
একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে সহকর্মীকে হেনস্তা, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা, সাবেক মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলেছেন তারা।
এদিকে গতকাল ঢাকা ও রংপুরের বিভাগীয় কমিশনারকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ দুই বিভাগীয় কমিশনারকে পরবর্তী পদায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. সাবিরুল ইসলাম ও রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. জাকির হোসেনকে শিগগিরই পরবর্তী পদায়ন করা হবে।
সারা দেশে আটটি বিভাগে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার আটজন বিভাগীয় কমিশনার রয়েছেন। অন্যদেরও শিগগিরই সরিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।