৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি, রোলস রয়েস, ৮০০০ ডলারের স্যুট: বিদেশে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর সম্পদের পাহাড়
বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। কয়েক মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তার এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়েকশো বিলাসবহুল বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়ি, কুমিরের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা, ইটালিয়ান স্যুট প্রভৃতি।
দোহাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সাবেক মন্ত্রীর সম্পদের এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে 'দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস' শিরোনামের ২৫.১১ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই প্রতিবেদনটি আল-জাজিরা ইংলিশ-এর ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়।
ভিডিওতে শোনা যায়, সম্পত্তিতে বিনিয়োগকারীর ছদ্মবেশে থাকা আল-জাজিরার সাংবাদিকদের সাইফুজ্জামান বলছেন, তার 'খুব সুন্দর একটা পেন্টহাউস আছে' এবং তিনি 'স্যুট খুব পছন্দ করেন' ।
ভিডিওর একপর্যায়ে স্যুট পছন্দ করেন জানিয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, তিনি লন্ডনে গেলে প্রতিবারই ২-৩ হাজার পাউন্ড খরচ করে স্যুট কেনেন। আর সুপার ২০০ ও সুপার ১৮০-র মতো স্যুট তার বিশেষ পছন্দের। 'একটা সুপার ২০০ স্যুটের খরচ পড়ে ৬ হাজার পাউন্ড (৮ হাজার ডলার),' বলেন তিনি।
আল-জাজিরার সাংবাদিকদের নিজের পেন্টহাউসও ঘুরে দেখান সাইফুজ্জামান।
তিনি বলেন, 'এটা একেবারেই প্রাইভেট বাড়ি। নিজের নিরাপত্তার জন্য আমার খুব নিরাপদ বাড়ি দরকার।'
পাঁচতলা বাড়িটিতে একটি হোম থিয়েটার, একটি জিম, একটি 'প্রাইভেট লিফট' এবং গ্যারেজে পার্ক করা 'নতুন রোলস রয়েস' রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক এই মন্ত্রী সামান্য সরকারি বেতনে অর্ধবিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তুলেছেন।
এ প্রতিবেদনের ওপরের জারি করা এক প্রেস বিবৃতিতে আল-জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক বলেছে, কড়া মুদ্রা আইনের কারণে বাংলাদেশের নাগরিকরা বছরে ১২ হাজারের ডলারের বেশি দেশের বাইরে নিতে পারেন না। আর সরকারি আইনে মন্ত্রীদের কোনো বেসরকারি ব্যবসায় পরিচালক পদ ধরে রাখা বা ব্যবসা থেকে মুনাফা করার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। সাইফুজ্জামান ব্রিটেনে ২৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৩৬০টিরও বেশি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন।
এসব বাড়ির বেশিরভাগই কেনা হয়েছে বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষস্থানীয় ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান থেকে। বাড়িগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য ৩২০ মিলিয়ন ডলার।
প্রেস বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতেও রিয়েল এস্টেট খাতে সাইফুজ্জামানের সম্পত্তি রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে ৯টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এর মধ্যে পাঁচটি ম্যানহাটনসহ নিউইয়র্কের প্রধান এলাকায় ও চারটি নদীর ওপারে নিউ জার্সিতে।
সাবেক এই মন্ত্রী দেশের বাইরের এত পরিমাণ সম্পদ তার নির্বাচনি হলফনামা ও ট্যাক্স ফাইলে গোপন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
এই রাজনীতিবিদ ক্ষমতাধরদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকা নিয়ে গর্ব করেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে।
সাইফুজ্জামান আল-জাজিরার সাংবাদিকদের বলেন, 'আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) খুব কাছের লোক ছিলেন। সত্যি বলতে, আমিও তা-ই। …উনি আমার বস…উনি জানেন এখানে (ব্রিটেনে) আমার ব্যবসা আছে।'
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলো কেনার মাধ্যমে তার সম্পত্তি কেনার গতি বাড়ে। তবে ২০১৯ সালে মন্ত্রী হওয়ার পর তার সম্পত্তি কেনার গতি আরও বেড়ে যায়।
আল-জাজিরার অনুসন্ধান অনুযায়ী, লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে সব সম্পত্তির দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। সিঙ্গাপুরের ব্যাংক ডিবিএস থেকে ঋণ নিয়েছেন সাইফুজ্জামান। ওই ব্যাংকের কর্মী রাহুল মার্টের বর্ণনায়ও সাইফুজ্জামানের সম্পদের খতিয়ান উঠে এসেছে।
আল-জাজিরার সাংবাদিকদের কাছে তার বিলাসী জীবনের গল্পও করেছেন সাইফুজ্জামান। নিজের জুতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'এটা টেইলর-মেড জুতা। আমি হ্যারডসেও কাস্টম মেড জুতা অর্ডার দিয়েছি। এটা বানাতে চার মাস সময় লাগে। আমি কিনেছি প্রতিটা তিন হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে।'
বিশেষ এই জুতা উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি বলে জানান সাইফুজ্জামান। সম্পূর্ণ বুকের চামড়া দিয়ে বানানো জুতাগুলোর দাম পড়ে ৬ হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও অর্ধেক বাছুরের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতার দাম পড়ে ৩ হাজার পাউন্ড।
গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছাড়ার পর শেখ হাসিনা এখন ভারতে নির্বাসনে রয়েছেন। আর সাইফুজ্জামান চৌধুরীসহ হাসিনা সরকারের অনেক মন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
আল-জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্কের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার যুক্তরাজ্যে পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ তার পরিবারের মালিকানাধীন ব্যাংক ইউসিবিএলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য।
আল-জাজিরার সাংবাদিকরা গত বছর সাবেক এই মন্ত্রীর সঙ্গে তার লন্ডনের ১৪ মিলিয়ন ডলার দামের বাড়িতে দেখা করেন। সেখানে সাইফুজ্জামান কুমিরের চামড়া থেকে হাতে বানানো জুতা ও ইটালিয়ান স্যুটের জন্য হাজার হাজার ডলার খরচ করা নিয়ে গর্বভরে কথা বলেন।
সাইফুজ্জামান আল-জাজিরাকে জানান, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আমেরিকায় তার বৈধ ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত আয় দিয়েই এই সম্পত্তিগুলো কেনা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী আরও দাবি করেন, তিনি একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।
লন্ডনে সাইফুজ্জামানের বাড়িগুলোর বিষয়ে আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেভেলপারদের কাছ থেকে বাড়ি কেনার জন্য তিনি বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সাবেক এই মন্ত্রী যুক্তরাজ্যে ২৬৫টি বাড়ি কেনেন।
এছাড়া সাইফুজ্জামান ২০২১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে লন্ডনে আরও সম্পদ কেনেন। ২০২০ সালে আরও ৮৯টি বাড়ি কিনলে মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০টি, যার বাজারমূল্য ৩২০ মিলিয়ন ডলার।
আল-জাজিরার সাংবাদিকরা ধনী বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ছদ্মবেশে সাইফুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রিপনের সাথে যোগাযোগ করেন। তারা চীন থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাজ্যের বাজারে স্থানান্তরের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
রিপন আল-জাজিরার সাংবাদিকদের সাথে লন্ডনের একটি হোটেলে দেখা করেন এবং সাইফুজ্জামানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, 'যা আপনারা চান, তার (সাইফুজ্জামান) জন্য আমি সেটা করেছি।'
রিপন আরও জানান, সাইফুজ্জামান সবসময় সতর্কতার সাথে কাজ করেন এবং বড় প্রকল্প এড়িয়ে চলেন, যাতে কারও নজরে পড়ে না যান।
আল-জাজিরার সাংবাদিকরা সাইফুজ্জামানের আইনি পরামর্শদাতাদের সাথে দেখা করে এবং জানতে পারে, তার কোম্পানির মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ-সংক্রান্ত আইনি কাজগুলো একজন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী পরিচালনা করছেন। ওই আইনজীবী ২০২১ সাল থেকে সাবেক মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের ১০০টিরও বেশি ঋণ-সংক্রান্ত আইনি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।
রিপন আরও জানান যে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বার্কলি হোমস থেকে তার মোট সম্পত্তির এক-চতুর্থাংশ কিনেছেন এবং দুবাইয়ে ৫৪টি সম্পত্তি তার মালিকানায় রয়েছে।
রিপনকে সঙ্গে নিয়ে সাইফুজ্জামানের সঙ্গে তার লন্ডনের বাড়িতে দেখা করে আল-জাজিরা অনুসন্ধানী দল। সেখানে সাইফুজ্জামান নিজে স্বীকার করেন যে, তিনি তার সব মুনাফা দুবাই ও লন্ডনে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি আরও বলেন, দুবাইয়ের ডাউনটাউনে তার পেন্টহাউস এবং সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তি রয়েছে।
তবে বাংলাদেশ থেকে এত অর্থ কীভাবে বিদেশে আনলেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে সাইফুজ্জামান বলেন, দুবাইয়ে তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসা আছে। দুবাই থেকে লন্ডনে টাকা এনে সেখান থেকে ঋণ নেন।
এবারই প্রথম নয়, এর আগেও সাইফুজ্জামানের বিপুল সম্পত্তির খবর প্রকাশ্যে এসেছে।
হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বিদেশি সম্পদের তদন্তে সহায়তা চেয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এতে যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামানের মালিকানাধীন ১৫০ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির অর্থের উৎস শনাক্তকরণে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বরাত দিয়ে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাসিনা ও তার সহযোগীরা দেশের ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছেন কি না, তার তদন্ত করছে অন্তর্বর্তী সরকার।
যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন কোম্পানির সম্পত্তি আছে বলে চলতি বছরের শুরুতে জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে। সেদেশে যে বাংলাদেশিদের এ রকম 'অব্যাখ্যাত সম্পদ' আছে, এটি তারই নজির বলে উল্লেখ করে সংস্থাটি।
যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন দপ্তর ও কোম্পানি-সংক্রান্ত দপ্তরের নথি খতিয়ে দেখেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। তাদের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি মূল্যের অন্তত ২৮০টি সম্পত্তি অর্জন করেছে।
এসব সম্পত্তির বেশিরভাগই ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কেনা হয়েছে। আর সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী ছিলেন। অর্থাৎ তিনি ভূমিমন্ত্রী থাকাকালীনই এসব সম্পত্তি কেনা হয়েছে।
এসব সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে লন্ডনের ফিটজরোভিয়া এলাকায় এমারসন বেইনব্রিজ হাউস, পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসে ৬১টি বাড়ি এবং ব্রিস্টলে একটি সমবায় সুপারমার্কেট।
যুক্তরাজ্যে এসব সম্পত্তি কেনার অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই। যদিও নথিপত্র দেখে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, কিছু সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে বন্ধকি ঋণ নেওয়া হয়েছে।
তবে সাইফুজ্জামানের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, তার মক্কেলের 'লুকানোর কিছু নেই' এবং তিনি কোনোকিছু চুরি করেননি।
চলতি বছরের শুরুতে এক সংবাদ সম্মেলনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তার বিদেশের সম্পত্তি আন্তর্জাতিক ব্যবসার আয় থেকে এসেছে।
বছরের শুরুর দিকে ব্লুমবার্গ নিউজও এক প্রতিবেদনে বলে, সাইফুজ্জামান ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি রিয়েল এস্টেট সম্পত্তির মালিক।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত মাসে সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে। চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে সাবেক এই মন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের তথ্যও চেয়েছে দুদক।