পরিবহন ধর্মঘট, ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের পর স্বাভাবিক হচ্ছে রাঙামাটির পরিস্থিতি
জাতিগত সংঘাতের জের ধরে সৃষ্ট অচলবাস্থা কাটিয়ে ৩ দিন পর পর্যটন শহর রাঙ্গামাটির সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। রোববার সকালে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের পর রাতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন পরিবহন শ্রমিকরা।
এরপর সোমবার সকাল থেকেই শহরের একমাত্র গণপরিবহন অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়। এর পাশাপাশি রাঙ্গামাটি শহর থেকে চট্টগ্রামমুখী বাস, ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচলও বাড়তে থাকে।
রাঙামাটি জেলা সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন ও চালক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান বাবু বলেন, "প্রশাসন আমাদের ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছেন। সোমবার সকাল থেকেই অটো রিকশাসহ অন্যান্য গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়েছে।"
বাস মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম-রাঙামাটি রুটে দৈনিক ৫০টিরও বেশি বাস শতাধিক ট্রিপে চলাচল করে। এতে দুই হাজারের মতো যাত্রী যাতায়াত করেন। রাঙ্গামাটি থেকে বাস চলাচল শুরু হলেও খাগড়াছড়ি রুটে এখনও যান চলাচল শুরু হয়নি।
চট্টগ্রাম বাস, মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের (চট্টগ্রাম-রাউজান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) সাধারণ সম্পাদক খোরশেদুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সোমবার সকাল থেকে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি রুটে যান চলাচল শুরু হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ের মতো সকাল সাড়ে ৬টায় রাঙামাটি প্রান্ত এবং চট্টগ্রাম প্রান্ত— দুদিক থেকেই বাস ছেড়ে আসে।"
সোমবার দুপুরে শহরের প্রধান তিনটি বাজার তবলছড়ি, রিজার্ভ বাজার এবং বনরূপা ঘুরে দেখা গেছে— প্রায় সকল মার্কেটে দোকানপাট খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতারাও আসতে শুরু করেছেন। ধীরে ধীরে পণ্য বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা করছেন বিক্রেতারা।
বনরূপা বাজারের বিএম শপিং কমপ্লেক্স এর সাধারণ সম্পাদক জাহান লিটন টিবিএসকে বলেন, "বনরূপা বাজারে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার দোকান রয়েছে। রোববার ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করার পর বিকেলে কিছু দোকান খোলেন ব্যবসায়রা। তবে সোমবার থেকে সবগুলো দোকান খুলেছে। নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রশাসন থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরন দেওয়া হবে।"
এদিকে, তবলছড়ি বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাজারে ক্রেতাদের একটি বড় অংশ পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর লোকেরা। গত শুক্রবার থেকে পাহাড়ি–বাঙালি কোনো সম্প্রদায়ের লোকজনই বাজারে আসেন নি। সোমবার থেকে উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন আসতে শুরু করেছেন। সড়কে যান চলাচল শুরু হওয়ায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্য, জীবনযাত্রা।"
আজ থেকে শুরু হচ্ছে নৌ রুটে চলাচল
রাঙামাটি কাপ্তাই হ্রদ বেষ্টিত জেলা। কাপ্তাই হ্রদে লঞ্চ, বোট যোগে জেলার ৬টি উপজেলায় যাতায়াত করেন যাত্রীরা। এসব উপজেলা থেকে পণ্য নৌকা যোগে রাঙ্গামাটি শহরের পৌর ট্রাক টার্মিনাল, বনরূপা, তবলছড়ি, রিজার্ভবাজার ঘাটে নিয়ে আসা হয়।
গত শনিবার থেকে বন্ধ আছে রাঙ্গামাটির সাথে ৬টি উপজেলার অন্তত ১০টি রুটে নৌ পথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন। তবে আজ মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) থেকে এসব রুটে নৌ চলাচল আবার শুরু হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা রাঙামাটি জোনের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিন সেলিম টিবিএসকে বলেন, "রাঙ্গামাটি শহরে জাতিগত সংঘাতের ফলে শনিবার থেকে নৌ রুটে চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় মঙ্গলবার থেকে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন শুরু হবে।"
টেক্সটাইল মার্কেটে তিনদিনে ক্ষতি কোটি টাকা
পর্যটন শহর রাঙামাটির পর্যটকদের আকর্ষণ টেক্সটাইল মার্কেট। এই মার্কেটের অন্তত ৩০টি দোকানে বিক্রি হয় পাহাড়ীদের হাতের তৈরি নানান পোশাক ও শো পিস।
রাঙামাটি শহরে জাতিগত সহিংসতায় গত শুক্রবার থেকে বন্ধ ছিল এসব দোকান। সোমবার থেকে পরিবহন শ্রমিকরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে দোকান। সোমবার দুপুর পর্ন্ত দেখা যায় অন্তত ১০টি দোকান খুলেছে। যদিও তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ক্রেতাশূন্য ছিল দোকানগুলো।
দোকানের মালিকরা জানিয়েছে, এই টেক্সটাইল মার্কেটের প্রধান ক্রেতা পর্যটকরা। পরিস্থিতি পুরোপরি স্বাভাবিক না হলে তাদের ব্যবসাও জমবে না। গত তিনদিনে এই মার্কেটের অন্তত এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন দোকান মালিকরা।
টেক্সটাইল মার্কেটের শো-পিস দোকান জুম বাজারের স্বত্বাধিকারী ইয়াছিন আরাফাত টিপু বলেন, গত তিন দিনে আমার প্রায় ৫০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। প্রতিটি দোকানের অবস্থা একই। জাতিগত সংঘাতের কারণে এই টেক্সটিইল মার্কেটে প্রায় কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এমনিতেই ব্যবসা বাণিজ্যে ধীরগতি। এরমধ্যে জাতিগত সংঘাতের কারণে তাদের ব্যবসা আবারও ক্ষতির সম্মুখীন। তারা পর্যটকদের রাঙামাটি শহরে ভ্রমণের আহ্বান জানান।
টেক্সটাইল মার্কেটের একটি দোকানের স্টাফ ফারজানা টিবিএসকে বলেন, "পর্যটক যদি না আসে এই মার্কেট পুরোটাই অচল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এই মার্কেটের ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে। মার্কেট ঘিরে কর্মরত শত শত স্টাফের চাকরি হুমকিতে পড়বে।"
প্রসঙ্গত, খাগড়াছড়িতে সিএনজিচালিত অটোরিকশা পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় শনিবার সকাল থেকেই অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয় মালিক সমিতি।
খাগড়াছড়ির সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটিতেও। শুক্রবার রাঙামাটি শহরের হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, সরকারী গাড়ি, বসতঘর মসজিদ, বৌদ্ধ বিহার কিছুই বাদ যায়নি ধ্বংসের কবল থেকে। এসব ঘটনায় জেলা প্রশাসন রাঙামাটি শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে।