বেশি ফলন, নিরাপদ সবজি: কোকোপিট চারা বদলে দিচ্ছে জয়পুরহাটের কৃষি অর্থনীতি
কোকোপিট চারা ব্যবহার করে নিরাপদ ও কীটনাশকমুক্ত সবজি চাষে ঝুঁকছেন জয়পুরহাটের কৃষকরা। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব এই চাষাবাদে ফলন যেমন বেড়েছে, তেমনি কৃষকদের আয়ও বাড়ছে।
নারকেলের খোসা থেকে উৎপন্ন প্রাকৃতিক উপাদান কোকোপিট, মাটির বিকল্প হিসেবে চারার চাষে ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব এই পদ্ধতিতে মাটি ছাড়াই চারা তৈরি হয়, যা মাটির তুলনায় বেশি পানি ধরে রাখে এবং চারা দ্রুত বাড়তে সাহায্য করে।
'মাটিতে উৎপাদিত চারা জমিতে রোপণ করলে সতেজতা হারিয়ে যায়। অনেক চারা মরে যায়। সার বেশি লাগে। ফলনও গতানুগতিক। কিন্তু কোকোপিটের চারা কৃষকের জন্য আশীর্বাদ। এটি দ্রুত বর্ধনশীল, ফসলের ফলনও দ্বিগুণ হয়।'
কোকোপিটের চারার গুণাগুণ বলতে গিয়ে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের মো. রিপন মিয়া কথাগুলো বলেন। এবার চার বিঘা জমিতে সবজির আবাদ করছেন তিনি।
রিপন বলেন, দুবছর আগেও বগুড়া থেকে চারা নিয়ে এসে চাষাবাদ করতাম। এখন জয়পুরহাটেই কোকোপিটে চারা হচ্ছে। সময় আর চাহিদা সাথে বদলে যাওয়া কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি এটি। মাটির চারাতে আগে ৭০ দিন পরে বেগুন চাষ করতে পারতাম। কিন্তু কোকেপিটের চারায় ৫২ দিনেই বেগুন বাজারজাত করা যায়।"
জয়পুরহাটে কোকোপিট চারা ব্যবহারে শুধু ফলনই বাড়ছে না, কমছে চাষাবাদের খরচও। রিপন মিয়ার মতো অন্যান্য কৃষকরাও বলছেন, এই চারায় কীটনাশক ও সার কম লাগে, কিন্তু সবজির আকার, গুণমান এবং সতেজতায় এর জন্য কোনো ঘাটতি হয় না। এ কারণে বাজারেও এসব সবজির চাহিদা বেশি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও কৃষকদের এমন অভিজ্ঞতার সাথে একমত। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, জেলায় কৃষকরা এখন উত্তম কৃষি চর্চা (গুড কালচারাল প্র্যাকটিস বা গ্যাপ) নীতি অনুসরণ করে নিরাপদ সবজি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন, যা ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ সবজি সরবরাহের সুযোগ তৈরি করছে।
জয়পুরহাটে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাকস ফাউন্ডেশনও নিরাপদ সবজি উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে। সরকারিভাবেও কৃষকদের বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এবং ডানিডার অর্থায়নে রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট (আরএমটিপি) পরিচালিত হচ্ছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে ২৫ জেলার ৪৫ উপজেলায় প্রায় ৮৭ হাজার কৃষক নিরাপদ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন, যেখানে ৩০ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে চাষাবাদের আওতায়। প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন অনুযায়ী, পরিবেশবান্ধব এই চাষাবাদে ৬৫ শতাংশ কৃষকের আয় ৪০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
শুধু জয়পুরহাটেই গ্যাপ নীতিতে চাষাবাদের জন্য অন্তত ১১ হাজার ৫০০ কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তাদের একজন পাঁচবিবির রামচন্দ্রপুর গ্রামের মানিক হোসেন। ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই কৃষক জানান, এবার তিনি ১৫ শতক জমিতে কোকোপিট চারা দিয়ে আগাম ফুলকপি চাষ করেছেন। ফলন দেখে আনন্দিত তিনি, কারণ এখানে নামমাত্র রাসায়নিক সার দেওয়া হয়েছে। উৎপাদন করা হয়েছে মূলত জৈব সার ব্যবহার করে।
পাঁচবিবি জেলার উত্তরকৃষ্ণপুর গ্রামে ৮ বিঘা জমিতে সবজি চাষ করছেন মো. মাসুদ রানা। তিনি জানান, মাটির চারা জমিতে রোপণ করলে ৫০ শতাংশই মরে যায়। কিন্তু কোকোপিটের চারা রোপণ করে মালচিং পদ্ধতি ব্যবহারে সতেজ থাকে। কীটনাশকও কম লাগে কারণ, কোকোপিটের চারা ছত্রাকমুক্ত হয়।
'গত বছর ১২ শতক জমিতে কোকোপিট চারা দিয়ে টমেটো চাষ করে ৪০ হাজার টাকা আয় করেছি। অথচ আগে এখানে ২০ হাজার টাকা আয় করাই কঠিন হতো। সবজিও নিরাপদ।', বলেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জয়পুরহাটে ৮ হাজার ৯৮৫ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়। এখানে প্রায় ১০ কোটি চারা দরকার পড়ে। কিন্তু জেলায় উৎপাদন হয় ৬০ লক্ষ। বাকি চারা অন্য জেলা থেকে নিয়ে আসেন চাষীরা। প্রায় দুই বছর আগে কোকোপিট চারা চালু হওয়ার পর থেকেই এর উচ্চ ফলন এবং গুণমানের কারণে চাহিদা বেড়েছে।
গবেষণাগারের ফলাফলের বরাতে জাকস ফাউন্ডেশনের উপ-নির্বাহী পরিচালক মো. আবুল বাশার জানান, মাঠ পর্যায়ে এখন অনেক কৃষক নিরাপদ সবজি উৎপাদন করছেন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ওয়াফেন রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে বেগুন ও পটলের গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক রয়েছে। কিন্তু আরএমটিপি প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপাদান পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ নিরাপদ সবজি উৎপাদন হচ্ছে।
জেলায় বতর্মানে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার চাষি এই উপায়ে সবজি উৎপাদন করছেন। তাদের দেখাদেখি অন্যান্যরাও উৎসাহিত হচ্ছেন।
স্থানীয় কৃষকরা নিরাপদ সবজি উৎপাদন করলেও ঢাকায় সেভাবে এর আলাদা বাজার এখনও তৈরি হয়নি। পিএসএফের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, 'এখন চাষিরাও বুঝতে পেরেছেন সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহারে প্রয়োজনই নেই। জৈব সার ব্যবহারে সবজি উৎপাদনও বাড়ে। সারের বিষাক্ত চক্র সম্পর্কে চাষীদের ধারণাও হয়েছে। রাসায়নিক সার ও বীজের চক্র থেকে বের হতে হবে। আমরা পুরোপুরি অ্যাগ্রো ইকোলজিক্যাল ফার্মে যেতে চাই'।
এই কাজের জন্য সরকারের ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে ফজলুল কাদের আরও জানান, রাসায়নিক সার ব্যবহারে আমাদের জমির ধীরে ধীরে উর্বরতা অনেকখানি কমে গেছে। ১৯৭০ সালের পর থেকে ধানের উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে। কিন্তু সারের ব্যবহার বেড়েছে ৫৪ গুণ। এই কারণে কৃষকের আয় বাড়েনি। কৃষক ও জনগণের কল্যাণেই প্রাকৃতিক ফার্মিং বা চাষাবাদ দরকার। অ্যাগ্রো-ইকোলজিক্যাল ফার্মিং রাতারাতি হবে না। দেশের মানুষ ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
অ্যাগ্রো-ইকোলজিক্যাল ফার্মিংকে সমর্থন করে জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. মজিবুর রহমান বলেন, "নিরাপদ উপায়ে সবজি উৎপাদনে জেলায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষেই কোকোপিটের চারায় ফলন বেশি হয়। আর কৃষকদের কাছে যাওয়ার আগে আমরাও উত্তম কৃষি চর্চার অনুশীলন প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। এটি আগামী দিনে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে ব্যাপক কাজে লাগবে। এর সুফল পাবে মাটি ও মানুষ।"