সড়ক প্রকল্পে ধীরগতি— মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন ২০ প্রকল্প পরিচালক
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ২৬টি প্রকল্প শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করা রয়েছে। তবে এরমধ্যে ২০টিরও বেশি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হবে না বলে গত ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সভায় জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালকরা (পিডি)।
সাম্প্রতিক বন্যা ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বেশিরভাগ ঠিকাদারদের অনুপস্থিতি-সহ নানান বাধায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তারা।
ফলে প্রকল্প পরিচালকরা ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে প্রকল্প বাস্তবায়নে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। যদিও এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই এক বা একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বারৈয়ারহাট-হেয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়কটির নির্ধারিত কাজের মাত্র ৩৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।
এই প্রকল্পে চট্টগ্রামের বারৈয়ারহাট থেকে খাগড়াছড়ির রামগড় পর্যন্ত গত সেপ্টেম্বরে ৩৮ কিলোমিটার (কিমি) সড়ক প্রশস্ত করার কথা। এরমধ্যে বনবিভাগের আওতাধীন ১২ কিমি পথ ২৪ ফুট চওড়া করা হবে। সড়কের বাকি অংশ করা হবে ৩৮ ফুট চওড়া। প্রকল্পটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১,২২৬ কোটি টাকা— যার ৫৯৪ কোটি টাকা ভারতীয় ঋণ।
এই প্রকল্পের মত কমপক্ষে আরও ২০টি প্রকল্প রয়েছে— আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারি বেশিরভাগ ঠিকাদারদের অনুপস্থিতি, নতুন সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা ও ব্যয় সংকোচন নীতি এবং বন্যার কারণে যেগুলোর বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের ১৩৪টি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বাজেটে ৩২,০৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে— যা বাজেটের মোট এডিপির ১২ শতাংশ। এরমধ্যে সরকারের কোষাগার থেকে রয়েছে ২১,২৪৭ কোটি টাকা এবং প্রকল্প ঋণ ৯,২২৮ কোটি টাকা। আর ১,৫৬৮ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি বরাদ্দ থেকে ৩৯৫ কোটি ও প্রকল্প ঋণ থেকে ৬২২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে— যা মোট বরাদ্দের ৬.৭৪ শতাংশ।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গত ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় মুঠোফোনে টিবিএসকে বলেন, "আগামী ২৮ অক্টোবর (সোমবার) মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করা হবে। এরপর ঠিক হবে কোন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়বে অথবা বাড়বে না।"
সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সময়মতো কাজ শেষ করা এখন বেশ কঠিন। বন্যার কারণে চলমান অনেক প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক প্রকল্পের ঠিকাদার অনুপস্থিত। এমনকি, নতুন কাজের জন্যও ঠিকাদার পাওয়া যাচ্ছে না।
"বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, এমন দরপত্রে সর্বোচ্চ ছয়টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে মাত্র একটি ক্ষেত্রে। অধিকাংশ দরপত্রে একটি বা দুটি করে প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। ফলে চলতি অর্থবছরে এডিপির বাস্তবায়ন স্বাভাবিকের তুলনায় কম হবে," বলেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, "বর্তমান সরকারের মতে, ব্যয় সংকোচন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও ভেরিয়েশন প্রস্তাব যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনাও দিয়েছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিডিরা ব্যয় বাড়ানো ছাড়া সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করছেন।"
যেসব প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ৪টি প্রকল্প রয়েছে। এরজন্য সরকারি কোষাগার থেকে ২,৭৮৩ কোটি টাকা এবং প্রকল্প ঋণ হিসেবে ৩,৮২৩ কোটি টাকা; অর্থাৎ মোট ৬,৬০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। প্রত্যেকটি প্রকল্পেরই মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ডিএমটিসিএল।
একইভাবে, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষও (ডিটিসিএ) তার ৫টি প্রকল্পেরও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। বিআরটিসির জন্য সিএনজি–চালিত এসি বাস কেনার জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কোষাগার থেকে ৩০০ ও প্রকল্প ঋণ ৪০০ কোটি টাকা; অর্থাৎ ৭০০ কোটি বরাদ্দ রয়েছে।
১,১৩৩ কোটি টাকা মোট ব্যয়ের এই প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বিআরটিসি এক বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। ইডিসিএফ এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পে কোনো ব্যয় হয়নি।
জানা গেছে, 'জরাজীর্ণ, অপ্রশস্থ ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিদ্যমান বেইলি সেতু ও আরসিসি সেতু প্রতিস্থাপন'— শীর্ষক প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে। গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি গাজীপুর) এর মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের মেয়াদ ইতোমধ্যে দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব একনেক সভা অনুমোদন করেছে।
ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট চলতি অক্টোবরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। প্রকল্প পরিচালক কমপক্ষে এক বছর ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন।
মাতারবাড়ী কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের সড়ক ও জনপথ বিভাগের অংশ শেষ করার কথা আগামী বছরের জুনে। কিন্তু প্রকল্পটি সময়মত শেষ হচ্ছে না। সময় বাড়ানোর আবেদন এসেছে প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে। গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প (রংপুর জোন) প্রকল্পটিরও মেয়াদ বাড়ানো হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পটি দুইবার সংশোধন হয়েছে।
আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ক চারলেন জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। এ প্রকল্পেরও মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
জরুরি সহায়তা প্রকল্প কক্সবাজার টেকনাফ সড়ক (এন-১) উন্নয়ন শীর্ষ প্রকল্পেরও সময় বাড়ানো হবে। এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। ঋণের পুরো অর্থ ব্যয় হচ্ছে না।
সিলেট তামাবিল পৃথক এসএমভিটি লেনসহ ৪ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
পানগুচি সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি আগামী বছরের জুনে শেষ করার কথা। কিন্তু সেটি হচ্ছে না বলে জানা গেছে। ঢাকা মহানগরে বাস রুট ন্যাশনালাইজেশন প্রজেক্টের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর ট্রান্সপোর্ট মাস্টার প্ল্যান প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন প্রকল্প পরিচালক।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিজস্ব অর্থায়নে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে যেসব প্রকল্পে বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ রয়েছে, সেগুলো চালিয়ে নিতে চায় সরকার। সেজন্য সরকারি প্রয়োজনীয় বরাদ্দও দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যতটুকু না করলেই নয়, ততটুকুই করা হবে। নতুন সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট না করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বর্তমান সড়ক ঠিকঠাক রাখা, বাড়তি প্রশস্ত না করা, বছর ওয়ারি খরচ কম করার জন্য ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে মেয়াদ বৃদ্ধির কৌশল নিয়েছে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ।