জনগণের মতামত নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির নির্দেশ সরকারের
ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে প্রকল্প নেওয়া রোধ এবং প্রকল্পের সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করতে উন্নয়ন প্রকল্পের প্রণয়ন-সংক্রান্ত পরিপত্রে পরিবর্তন এনেছে সরকার। বুধবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে জারি করা এ-সংক্রান্ত পরিপত্রে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নের আগে জনসাধারণের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্প প্রস্তাব তৈরির আগে প্রকল্পের বিভিন্ন তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে এবং জনগণকে অনলাইনে মতামত দেওয়ার জন্য ২ সপ্তাহ সময় দিতে হবে।
এই মতামত নিতে হবে প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদেনর জন্য পরিকল্পনা কমিশনের পাঠানোর আগে।
জনসাধারণের মতামত নেওয়ার জন্য প্রকল্পের প্রয়োজনীয় তথ্য, যেমন: সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, প্রকল্প গ্রহণের পটভূমি, যৌক্তিকতা, প্রকল্প এলাকা, আর্থিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্য ফলাফল, পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব, দুর্যোগের ঝুঁকি ও ঝুঁকি প্রশমন পরিকল্পনা, প্রযো্জ্য ক্ষেত্রে গ্রিন অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট নির্দেশক সংবলিত অংশ ওয়েবসাইটে থাকতে হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, 'প্রকল্প নেওয়াই হয় জনগণের জন্য। এই কারণে প্রকল্প নেওয়ার আগে যাদের জন্য নেওয়ার হচ্ছে, তাদের মতামত নেওয়া দরকার। অনেক প্রকল্প হয়েছে, জনগণের কাজে লাগেনি। জনগণের কাজে না লাগা মানেই হলো অর্থের অপচয়। রাজনৈতিক বিচেনায় নয়, প্রকল্প নিতে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে। এ কারণে যার জন্য প্রকল্প বা উপকারভোগী যারা হবে, তাদের মতামত নিয়েই প্রকল্প নেওয়া উচিত। ফলে সরকারের এই উদ্যোগটি একটি ভালো উদ্যোগ।'
দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। আবার ঠিকাদার বা গোষ্ঠীস্বার্থেও প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অনেক প্রকল্পে জনগণের কোনো সস্পৃক্ততা নেই।
এ ধরনের অপচয় ও দুর্নীতি রোধ করতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন-সংক্রান্ত ২০২২ সালের একটি পরিপত্র সংশোধের কথা জানিয়েছিলেন তিনি।
২০২২ সালের জুনে প্রণয়ন করা সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন সংক্রান্ত পরিপত্রে নতুন করে বিষয়টি যোগ হবে। সর্বশেষ এই উদ্যোগে প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জনগণের মতামত গ্রহণের বিষয়টি এই পরিপত্রে সংযোজন করা হবে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নে প্রথমবারের মতো এভাবে জনগণের মতামত নেওয়া হচ্ছে।
গতকাল (৩১ অক্টোবর) উপদেষ্টা পরিষদের সভায় উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে প্রকল্প শুরু করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কমিউনিটির প্রয়োজন বিবেচনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প জনগণ চায় কি না কিংবা কীভাবে চায়, এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তাদের স্বার্থ কতটুকু পূরণ হবে—এসব বিষয় জেনে প্রকল্প নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সভায়।
এই উদ্যোগে ফল আসবে কি?
উদ্যোগটি আকর্ষণীয় হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারণ অনেক মানুষ, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায়, প্রযুক্তি সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখেন না; তারা অনলাইনে মতামত দিতে সমস্যায় পড়তে পারেন।
পরিকল্পনা কমিশনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গ্রামাঞ্চলের মানুষ মন্ত্রণালয় বা বিভাগের ওয়েবসাইটে ঠিকমতো মতামত দিতে পারবেন কি না, তা এখনও অনিশ্চিত।
তিনি বলেন, 'সেক্ষেত্রে উদ্যোগী মন্ত্রণালয়েরই কোনো প্রকল্প নেওয়ার আগে প্রকল্প এলাকায় গিয়ে জনগণের সঙ্গে বৈঠক করা উচিত। একইসঙ্গে জেলা প্রশাসক, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করার উচিত। আবার জাতীয় পর্যায়ে বা কারিগরি প্রকল্প হলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া উচিত।'
পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন-আল-রশীদ এই উদ্যোগটিকে প্রশংসনীয় বলে মন্তব্য করেছেন। তবে তিনি বলেন, পূর্বের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, আইন বা নীতিমালা সম্পর্কে মতামত নেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটে জনসম্পৃক্ততা কম দেখা যায়।
অতীত অভিজ্ঞতায় তারা দেখেন, বিশেষ করে কোনো আইন বা নীতিমালা জন্য মতামত নেওয়ার ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটে জনগণ তেমন সাড়া দেয় না।
তিনি বলেন, 'যদি জনগণ ওয়েবসাইটে দেখে সক্রিওভাবে অংশগ্রহণ করে, তাহলে খুবই ভালো। তবে এই উদ্যোগ সফল করতে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। যেমন কত দিনের মধ্যে কতজন মতামত দিলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন, তার একটা প্যারামিটার তৈরি করতে হবে। এবং কোনো বিষয়ে মত চাওয়া জন্য জনগণকে তার সূত্র ধরিয়ে দিতে হবে বা প্রশ্ন ছুড়ে দিতে হবে। যেমন যে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে সেটি আমাদের দেশের জন্য বা ওই জায়গার জন্য আদৌ দরকার আছে কি না। কত খরচের মধ্যে আপনি ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন চান। এমন আট-দশটি প্রশ্ন দিয়ে দিতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, এই পরিপত্র যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে ব্যক্তির বা রাজনৈতিক প্রভাব, গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রকল্প নেওয়া বন্ধ হবে।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও গবেষক জায়েদ বখত বলেন, 'উন্নয়ন প্রকল্পে জনগণকে যুক্ত করা মহৎ উদ্যোগ। তবে মতামতটি যদি যথাযথভাবে নেওয়া না হয়, তাহলে প্রকৃত মতামত উঠে আসবে না। সেজন্য জনমত সংগ্রহের বিষয়টি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'বিজ্ঞানসম্মতভাবে মতামত নিতে। সেই অনুযায়ী প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে গিয়ে মতামত নিতে হবে। আবার জাতীয় পর্যায়েও মতামত দেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে।'