লিবিয়ায় যেভাবে দাসত্বের শেকলে আটকা পড়ছেন বাংলাদেশিরা
বেশ কয়েক বছর ধরে ভালো পারিশ্রমিকের আশায় লিবিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশি তরুণেরা। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাচারকারীদের শিকার হচ্ছেন তারা।
বর্তমানে লিবিয়ায় আনুমানিক ২০ হাজার বাংলাদেশি কর্মরত আছেন। তাদের বেশিরভাগের মতেই কর্মক্ষেত্রে খারাপ আচরণের পাশাপাশি, বেতন না দেওয়া এবং অসহনীয় পরিস্থিতিতে বসবাস করা সেখানকার শ্রমিকদের জন্য একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।
এদেরই একজন হলেন আলী (ছদ্মনাম)।
২০১৯ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে একটি ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা শুরু করেন তিনি।
কয়েক বছর ধরে রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে একটি প্রসাধনী দোকানে কাজ করতে থাকা আলী স্বপ্ন দেখতেন সচ্ছল জীবন যাপনের। দোকানের উপার্জন দিয়েই গ্রামে বসবাসরত বাবা-মাকে দেখাশোনার চেষ্টা করতেন তিনি।
সেবছর একজন 'দালাল' বা ট্রাভেল এজেন্টই প্রথম তাকে লিবিয়া যেতে উৎসাহিত করে। প্রকৃতপক্ষে দলটি ছিল মানব পাচারকারীদের। অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তরুণ বাংলাদেশিদের প্রলুব্ধ করার জন্য সামাজিক মাধ্যমে অত্যাধুনিক তৎপরতা চালাতো তারা।
দালালরা মূলত আলীর মতো তরুণদের আশাকে পুঁজি করে তাদেরকে বিভিন্ন দেশে পাচার করে থাকে। লিবিয়ার জন্য ইতোমধ্যে যাত্রা করা বেশিরভাগ লোকই দেশটি সম্বন্ধে খুব কমই জানেন। নৃশংস গৃহযুদ্ধ চলতে থাকা দেশটিতে পাচার হওয়া লোকদের জন্য অপেক্ষা করে দুঃখ, শোষণ এবং দাসত্ব।
"লিবিয়া সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না," আলী স্বীকার করেন।
আলীকে পাচার করার কৌশল হিসেবে তার বাবা-মায়ের সাথেও দেখা করে ঐ দালাল। লিবিয়ার কারখানায় কাজ করে মাসে আলী ৫০০ ডলার পর্যন্ত উপার্জন করতে পারবে বলে জানিয়েছিল সে। আলী বলেন, তার যাত্রার খরচ বহনের জন্য নিজেদের গোয়ালের একটি গরু বিক্রি করে টাকা দেন তার বাবা-মা।
মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে আটক
লিবিয়ায় পৌঁছাতে আলীর এক সপ্তাহ সময় লাগে। ঢাকা থেকে বাসে করে প্রথমে ভারতের কলকাতায় যান তিনি। তারপর বিভিন্ন ফ্লাইটে মুম্বাই, দুবাই এবং কায়রো হয়ে পৌঁছান লিবিয়া।
লিবিয়ার বেনগাজি বিমানবন্দরে অবতরণের পরই তিনি বুঝতে পারেন যে, নিরাপত্তাবিহীন একটি 'বিশৃঙ্খল' শহরে প্রবেশ করেছেন তিনি।
লিবিয়া পৌঁছানোর সাথেসাথেই আলীর দালালের স্থানীয় হ্যান্ডলাররা তাকে একটি কারাগারে নিয়ে যায় যেখানে তারা তার কাছে থাকা অর্থ কেড়ে নিয়ে তাকে মুক্তিপণের জন্য আটকে রাখা হয়। অবশেষে তাকে মুক্ত করার জন্য তার বাবা-মাকে নিজেদের শেষ সম্বল- অবশিষ্ট গরু দুটি বিক্রি করতে বাধ্য হন।
গদিবিহীন একটি ছোট কক্ষে আরও ১৫ জন বাংলাদেশির সাথে আটক ছিলেন তিনি। আলি জানান, মুক্তিপণের টাকা দিতে অক্ষম ব্যক্তিদেরকে খাবার-দাবার ছাড়াই আটকে রাখা হয়।
"আমার সামনেই একজনকে মেরে রক্তাক্ত করে দেয় তারা। কিন্তু তাকে কোনো সাহায্য করা হয়নি বা হাসপাতালেও নেওয়া হয়নি," বলছিলেন আলী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিবিয়াতে পাচারকারীদের হাতে আটক বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভয়াবহ।
গত বছরের মে তে, লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির কাছে মিজদাহের একটি গুদামে ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ২৬ জনই ছিলেন বাংলাদেশি। সে হত্যাকাণ্ডে বেঁচে যাওয়া একজন জানিয়েছিলেন, মুক্তিপণের টাকা দিতে না পারায় হত্যা করা হয় তাদেরকে।
বিনা বেতনে কাজ
পাচারকারীদের হাত থেকে মুক্তির পর তাদেরই জন্য বেনগাজিতে একটি পানির বোতলজাত প্ল্যান্টে তিনি মাস কাজ করেন তিনি। এরপর একটি টালি কারখানায় কাজের জন্য ত্রিপোলি যাত্রা করেন তিনি।
সেখানে কাজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন তিনি।
"আমরা কাজ বন্ধ করলে আমাদের মারধর করা হতো, লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া হতো। একবার আমাদের মধ্যে একজন একটা টালি ভেঙ্গে ফেললে মারধর করা হয় তাকে," বলছিলেন আলী।
তিনি বলেন, "কারখানার মালিক আমাদেরকে কাজ করতে নিয়ে যেতেন এবং কাজ শেষ হলে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আমাদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না। সেখানে দুজন প্রহরী সর্বদাই আমাদের পাহারা দিতো। বেতন ও পর্যাপ্ত খাবার ছাড়া রাখা হতো আমাদেরকে। পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম আমরা।"
তাদের মধ্যে একজন পালানোর চেষ্টা করলে দ্বিতীয় তলা থেকে পড়ে যেয়ে পা ভেঙে ফেলে বলে জানান তিনি।
পালানোর কয়েকটি ব্যর্থ চেষ্টার পর, একদিন আলীকে একটি মসজিদে আশ্রয় দেন এক লিবিয়ান। সেসময় নিজের পাচারকারীদের সাথে যোগাযোগ ছাড়া আলীর কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। তবে, এবার তিনি যোগাযোগ করেন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যাওয়ার লক্ষ্যে।
প্রতিকূল সাগড় পাড়ি
আলীর হিসাবমতে বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য তার বাবা-মা তাকে প্রায় ৪ হাজার ডলার দেন।
গত বছরের জুলাইয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়া ছিল আরেকটি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। একটি ডিঙিতে সমুদ্র পাড়ি দেন তিনি। এসময় তার সাথে ছিলেন আরও ৭৯ জন অভিবাসী।
"পুরো দুই দিন ধরে আমরা শুধু সমুদ্রই দেখেছি। তারপরে আমরা দূর থেকে দুটি হাঙর দেখতে পাই। ভেবেছিলাম সেখানেই সব শেষ," বলেন তিনি।
অবশেষে তাদেরকে উদ্ধার করে সিসিলিতে স্থানান্তরের আগে ল্যাম্পেডুসা দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়।
বর্তমানে নাইজেরিয়া, গাম্বিয়া এবং সেনেগালের মতো জায়গা থেকে আসা অন্যান্য তরুণ অভিবাসীদের সাথে সিসিলির রাজধানী পালেরমোর উপকণ্ঠে একটি অভিবাসী শিবিরে থাকেন আলী।
সুশিতে মোড়ানো স্বপ্ন
আলীর অস্থায়ী ডকুমেন্ট থাকায় ইতালিতে বসবাসের অনুমতি রয়েছে তার। তবে, মানবিক সুরক্ষার জন্য তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
আলী এখন পালেরমোতে আফ্রিকান অভিবাসীদের সাথে একটি সুশি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। পালেরমোর নতুন সাংস্কৃতিক মিশ্রণের সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন তিনি।
সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করে মাসে প্রায় ৮৭০ ডলার উপার্জন করেন তিনি। এর মধ্যে থেকে ৫৭০ ডলার দেশে পাঠান আলী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পালেরমোতে সুশির বাজার ক্রমশই বেড়ে উঠছে। জাপানিদের পাশাপাশি চীনা ক্রেতারাও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন এই খাতে।
এখানে আসার আগে কখনও সুশির নামও না জানা আলী বলেন, "আমি ঠিকঠাক সুশি বানানো শিখতে চাই। পাশাপাশি ইতালীর ভাষাও শিখতে চাই আমি।"
- সূত্র- বিবিসি