প্রেমিকের হাত ধরে তুর্কি কন্যা ময়মনসিংহে
তুর্কির অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতান সুলেমান ক্রীতদাসী হুররামকে ভালোবেসে, দুইশ বছরের নিয়ম ভেঙে বিয়ে করেছিলেন। তাদের প্রেমকাহিনীর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তবে সুলতান সুলেমান কি কখনো ভেবেছিলেন, তার দেশের এক মেয়ে ভালোবাসার টানে চলে আসবেন বাংলাদেশে!
আয়েশা ওজতেকিন তুরস্ক থেকে প্রেমিকের হাত ধরে এসেছেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়।
"বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় অনেক নরম। তাদের মাঝে ভালোবাসাটা একটু বেশি, অনেক আবেগী তারা। এ কারণে আমি হুমায়ুনের প্রতি আকৃষ্ট হই। তার গুণ বলে শেষ করা যাবে না। আমি তাকে খুব ভালবাসি", একটানে কথাগুলো বলে ওঠেন তুর্কি কন্যা আয়েশা।
তিনি বলেন, " প্রথমে বাবা এই বিয়েতে রাজি ছিলো না, কিন্তু পরে মা বাবাকে রাজি করান। আমি খুব খুশি যে বিয়ের মঞ্চে উঠতে যাচ্ছি", শুক্রবার বিয়ের মাত্র কিছুক্ষণ আগে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেন আয়েশা।
তুরস্কে চাকরির সুবাদে আয়েশা ওজতেকিনের সঙ্গে পরিচয় হয় ময়মনসিংহের তরুণ হুমায়ুন কবিরের। ধীরে ধীরে হয় মনের বিনিময়। এই মনের টানেই প্রেমিকের হাত ধরে তুরস্ক থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় ছুটে এসেছেন আয়েশা। শুক্রবার বিয়েরবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তুর্কি কন্যা এখন বাংলার নববধূ। মুক্তাগাছা পৌর এলাকার একটি কমিউনিটি সেন্টারে বাঙালি আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় আয়েশা-হুমায়ুনের বিয়ের আয়োজন।
আয়েশা ময়মনসিংহে এসে এখানকার মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ এবং অভিভূত। বলেন, "ময়মনসিংহ তো আমার খুব ভালো লাগছে। এখানকার মানুষ অনেক আন্তরিক। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়িও আমাকে অনেক আদর করেন। এখানে আসার পর সবসময়ই প্রতিবেশিরা আমাকে দেখতে আসছেন। যখন বিমানবন্দরে এসে নেমেছিলাম, তখন প্রায় ৫০-৬০ জন মানুষ আমাকে আনতে গিয়েছিল। আমি প্রচণ্ড আনন্দিত এবং অবাক হয়েছিলাম।"
হুমায়ুন রংপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ২০১০ সালে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যান তুরস্কে। আংকারা শহরের হাজেত্তেপে ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিন বিভাগে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। এরপর ২০১৮ সাল থেকে আনাতোলিয়া শহরের লাইফ হসপিটালে শুরু হয় তার কর্মজীবন। ওই হাসপাতালেই প্রধান হিসাবরক্ষক হিসেবে চাকরি করতেন তুর্কি তরুণী আয়েশা ওজতেকিন। সেই চাকরির সুবাদে পরিচয় দুজনের। পরিচয় থেকেই কাছে আসা এবং অবশেষে দুই পরিবারের সম্মতিতে একে-অপরকে সারা জীবনের সাথী করে নেয়া।
হুমায়ুন কবির বলেন, "তুরস্কে সাধারণত এই উপমহাদেশের মানুষ খুব কম থাকে। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতিও একেবারেই আলাদা। এগুলো জানার আগ্রহ থেকেই মূলত আমার সাথে পরিচয় তার। আমাদের নিয়মিত নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হতো। সে থেকেই আস্তে আস্তে প্রেম এবং অবশেষে বিয়ে।"
তিনি বলেন, "প্রেম এবং বিয়ের ক্ষেত্রে আয়েশার আগ্রহটাই বেশি ছিল। আসলে এমন কিছুর জন্য তো কোন পরিকল্পনা থাকে না। দেশের বাইরের অন্য আরেকজনের সাথে প্রেম-সম্পর্ক-বিয়ের বিষয়টি অবশ্যই একটু খুঁকিপূর্ণ।
তবে তার যেহেতু আগ্রহটা বেশি ছিল বা সেই এগিয়ে এসেছে, আমিও তাতে সাড়া না দিয়ে পারিনি। বাবা প্রথমে রাজি না থাকলেও মা তাকে খুব পছন্দ করেছিলেন, পরে বাবাও রাজি হয়েছেন। অবশেষে আমরা সারাজীবনের জন্য এক হতে পেরেছি। বাংলাদেশে এসে খুব সহজেই নিজেকে মানিয়েও নিয়েছে সে। সহজেই মিশে যাওয়ার ক্ষমতা এবং মিষ্টি হাসিতে ইতিমধ্যেই বাবা-মায়ের মন জয় করে নিয়েছে সে।"
হুমায়ুন কবির ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা পৌর এলাকার হাসান আলী ও হোসনে আরা দম্পতির ছেলে। আর আয়েশা ওজতেকিন তুরস্কের আনাতোলিয়া শহরের মাহমুদ ওজতেকিন ও সেফদা ওজতেকিন দম্পতির মেয়ে।
হুমায়ুনের বাবা বলেন, "কয়েকদিন হল সে এখানে এসেছে। ভিন্ন সংস্কৃতির মেয়ে হয়ে এ কয়দিনেই সে যেভাবে আমাদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, তা সত্যিই অকল্পনীয়। পুত্রবধু হিসেবে তাকে পেয়ে আমরা অত্যন্ত খুশি।"
মা হোসনে আরা বলেন, "ছেলের সাথে যে সময় থেকে আয়েশার সম্পর্ক তখন থেকেই তার সাথে আমি ভিডিও কলে কথা বলতাম। এখানে আসার পর সে আমাদের সঙ্গে যেভাবে মিশেছে, বাঙালি মেয়েরাও সেভাবে মিশতে পারে না।"
হুমায়ুনের মামা শফিকুল ইসলাম বলেন, "আমরা খুবই উচ্ছ্বসিত। আমি মনে করি এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে শুধু আয়েশা-হুমায়ুনের মিলনই ঘটল তা কিন্তু নয়, এটা দুই দেশের একটি মেলবন্ধন। এর মাধ্যমে দুই দেশের সংস্কৃতির আদান-প্রদানের সুযোগ তৈরি হল।"