কাজ মাঠে গড়ানোর আগেই ১১% ব্যয় বাড়ছে হেমায়েতপুর-ভাটারা মেট্রোরেলের
বিশদ নকশা তৈরি, জমি অধিগ্রহণ ও ঠিকাদার জোগাড়ে বিলম্বের কারণে হেমায়েতপুর-ভাটারা মেট্রোরেলের ব্যয় ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগেই।
বিশদ নকশা তৈরির কাজ অক্টোবরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ২৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ কাজ কাজ শেষ করতে চায় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
ভূমি অধিগ্রহণের কাজ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শেষ করার কথা থাকলেও তা শেষ করতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চাইছে ঢাকা মেট্রোরেলের কাজ বাস্তবায়নকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি।
ঠিকাদার নিয়োগের কাজ ২০২৩ সালের নভেম্বরে শেষ করার কথা থাকলেও, কোভিড মহামারির কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আরও দুই বছর পর, ২০২৫ সালের আগস্টে এ কাজ শেষ করতে চায় ডিএমটিসিএল।
২০২৮ সালে যাত্রী পরিবহন শুরু করতে তৃতীয় মেট্রোরেল হিসেবে ২০১৯ সালে এমআরটি লাইন ৫ (উত্তরাঞ্চল রুট) প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। কিন্তু এরপর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও মাঠ পর্যায়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।
যেহেতু প্রাথমিক প্রস্তুতির সব কাজ পিছিয়ে পড়েছে, তাই প্রতিদিন ১৪ লাখের বেশি যাত্রীকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের আগে শুরুর কোনো সম্ভাবনা নেই।
প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপের ঋণচুক্তির লক্ষ্যে টানা ১৫ দিনের সিরিজ বৈঠক শেষে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছে ঋণদাতা সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।
জাইকা সূত্র জানিয়েছে, ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রেললাইন নির্মাণের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৬ লাখ ৫ হাজার ২৫০ মিলিয়ন ইয়েনে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৪৫ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৪১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ খরচ বাড়বে ৪ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং ডিএমটিসিএল-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে জাইকা মিশনের সিরিজ বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, ভূমি অধিগ্রহণের খরচ বৃদ্ধি, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, নির্মাণের সময়সূচি হালনাগাদ করা এবং মুদ্রাবিনিময় হারে পরিবর্তন আসার কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে।
ডিএমটিসিএল বলেছে, করোনার জন্য পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব হওয়ায় প্রকল্পের কাজের গতি ধীর হয়ে গেছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিটের কর্মকর্তা নিয়োগে প্রচণ্ড ধীরগতি দেখেছেন জাইকা কর্মকর্তারা। অবিলম্বে কিছু বড় পদে নিয়োগের ওপর জোর দিয়েছেন তারা। কিছু বিতর্কিত সমস্যার সমাধান খোঁজার ওপরও জোর দিয়েছেন জাইকা কর্মকর্তারা।
প্রকল্পের জন্য ১৩ হাজার ৩১১ দশমিক ৫ কোটি টাকা দিতে রাজি হয়েছে জাইকা মিশন। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের খরচ মেটাতে দ্বিতীয় ধাপে এ অর্থ দেবে জাইকা।
কেন এই প্রকল্প
১৯৯০ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৬৬ লাখ। ২০১৮ সালে শহরটির জনসংখ্যা বেড়ে হয় ১ কোটি ৯৮ লাখ। ২০১০ সালে ঢাকায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার ৬০০। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০। এর ফলে ঢাকার সীমিতসংখ্যক রাস্তায় যানজট বেড়েছে ব্যাপকভাবে।
এ কারণে যানবাহনের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে, গাড়িতে যাতায়াতকালে যানজটে নষ্ট হচ্ছে প্রচুর সময়। এছাড়া যানজটের কারণে বছরে অন্যান্য আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৮০ কোটি মার্কিন ডলার।
নগরের পরিবহন ও পরিবেশের ক্রমবর্ধমান সমস্যা মোকাবিলায় ঢাকার যানজট কমাতে পাঁচটি এমআরটি লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এই পাঁচ লাইনের একটি প্রকল্প হলো এমআরটি লাইন ৫ (উত্তর)। এ লাইনে প্রতিদিন ১৪ লাখ ৭৮ হাজারেরও বেশি যাত্রী যাতায়াত করবেন।
এ লাইনে রাজধানীর পশ্চিমের হেমায়েতপুর থেকে ২০ কিলোমিটার পূর্বে ভাটারা পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩২ মিনিট। লাইনটি যাত্রীদের ভ্রমণের সময় ৭৪ শতাংশ, অর্থাৎ ৯০ মিনিট কমাবে।
কর্মী নিয়োগে বিলম্ব
কর্মী নিয়োগে অস্বাভাবিক বিলম্বের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাইকা মিশন। অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক, উপ-প্রকল্প পরিচালক, সহকারী প্রকল্প পরিচালক এবং সহকারী প্রকৌশলীর ৮২টি মূল পদের মধ্যে মাত্র ১৩টি পদে নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে এ পর্যন্ত। অথচ এ কাজ সম্পন্ন করার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনের।
ডিএমটিসিএল বলেছে, এ বিলম্বের মূল কারণ করোনা মহামারি। সংস্থাটি বলেছে, তিনজন অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক এবং ১৪ জন উপ-প্রকল্প পরিচালকের নিয়োগ যথাক্রমে ২০২২ সালের মার্চ ও জুনের মধ্যে শেষ হবে।
ডিএমটিসিএল কর্মকর্তারা আশ্বস্ত করেছেন, ২০২৩ সালের জুনে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগে সমস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ সম্পন্ন করা হবে।
ভূগর্ভস্থ অংশে ভূমির নিরাপত্তা চায় জাইকা
মেট্রোরেল আইনে একটি অধ্যায় যোগ করার ওপর জোর দিয়েছে জাইকা মিশন। প্রকল্পের ভূগর্ভস্থ অংশের ওপরের ভূমির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এ আইন প্রণয়ন করার ওপর জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। ভূমির ওপরের বাধা সৃষ্টিকারী অবকাঠামো থেকে ভূগর্ভস্থ অবকাঠামোকে রক্ষা করার জন্য ভূগর্ভস্থ অংশে ভূমির নিরাপত্তা প্রয়োজন।
মেট্রোরেল আইন সংশোধনের মাধ্যমে সারফেস রাইটস আইন প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সমন্বয় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ডিএমটিসিএল। মেট্রোরেল আইন সংশোধনের প্রস্তুতি শুরু করবে প্রতিষ্ঠানটি।
লাইনের জন্য ক্যান্টনমেন্টের এনওসি
প্রকল্পটি সরাসরি সেনানিবাসের ভূগর্ভ দিয়ে যাবে। এ কারণে ঢাকা সেনানিবাসের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র (এনওসি) পাওয়ার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার ওপর জোর দিয়েছেন জাইকা কর্মকর্তারা।
ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, ২০১৮ সালের এপ্রিলেই প্রকল্পের জন্য ১৩টি শর্তসংবলিত এনওসি দেওয়া হয়েছিল। ডিএমটিসিএল ১৩টি শর্ত পূরণ করার পর, নির্মাণ শুরুর আগে, ২০২২ সালের জুনের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করবে।
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
২৯১৬ সালে ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারির ঘটনার পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাইকা মিশন। জাপানি কোম্পানিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ মানের নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষকে জোর অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি।
ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, পরামর্শদাতা অফিসের ২৪ ঘণ্টা সুরক্ষার জন্য দুটি প্লাটুন প্রয়োজন। জাইকা মিশন পরামর্শক দলের সাইট পরিদর্শনের জন্য আরেকটি প্লাটুন রাখার প্রস্তাব দিয়েছে।
নিয়োগ বিলম্ব ও খরচ বাড়ার ব্যাখ্যা দিল ডিএমটিসিএল
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সিনিয়র পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু সমস্যা রয়েছে।
তিনি বলেন, ডিএমটিসিএল একটি টাইমলাইন দিয়েছে। সেই অনুযায়ী নিয়োগ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্যয় বৃদ্ধি-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে মুদ্রার বিনিময় হার কমলে সামগ্রিক ব্যয় কমতে পারে।
তিনি জানান, করোনা মহামারির কারণে বর্তমানে কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ পিছিয়ে রয়েছে। তবে সম্প্রতি কাজের গতি বেড়েছে।
এমএএন সিদ্দিক বলেন, বাড়তি কর্মঘণ্টার মাধ্যমে ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে পূর্ত কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করেছে ডিএমটিসিএল।
দক্ষ লোক নিয়োগের জন্য বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক, পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক প্রকল্পের ধীরগতির জন্য দক্ষ জনবলের অভাবকে দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, মেগা অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার অনেকাংশেই পরামর্শদাতা ও ঠিকাদারদের ওপর নির্ভরশীল।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, খরচের পরিমাণ বাড়িয়ে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, পরামর্শদাতা ও ঠিকাদাররা সবসময়ই যেকোনো প্রকল্পের গতি কমানোর চেষ্টা করে। এ কারণে প্রকল্পটির কাজে গতি আনতে সরকারকে দক্ষ জনবল নিয়োগের আহ্বান জানান শামসুল হক।
তিনি আরও বলেন, 'এমআরটিগুলো বাংলাদেশে অত্যন্ত ব্যয়মুখী প্রকল্প। এ ধরনের পরিষেবাগুলোর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও অনেক বেশি। এমআরটি প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি জনগণের জন্য পরিষেবার খরচ অথবা সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে।'