হুন্ডি কাজল: দেশের প্রথম পঞ্জি স্কিমের হোতা
২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা! ফারুক আহমেদ কাজল, ওরফে হুন্ডি কাজল ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে এই পরিমাণ টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন।
দেশের অন্যতম বৃহৎ এবং সর্বপ্রথম আর্থিক কেলেঙ্কারির এই ঘটনাটি ঘটেছে ঝিনাইদহের একটি নিভৃত গ্রামে। কাজল এখন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি হলেও ধ্বংসের যে নমুনা তিনি রেখে গেছেন, তা পুরো এলাকাকে এখনও তাড়া করে বেড়ায়।
কিন্তু হুন্ডি কাজল কীভাবে মানুষকে এভাবে প্রতারিত করতে পেরেছিলেন? তিনি কি একাই এ কাজ করতেন?
'হুন্ডি কাজলকে কে না চেনে? কেউ হয়তো তার সম্পর্কে কথা বলতে চাইবে না, কিন্তু তাদের অনেকেই কাজলের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেছে। আবার তাদের মধ্যে অনেকেই সর্বস্ব হারিয়েছে,' বলেন ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের চা বিক্রেতা রিন্টু।
দেশের সবচেয়ে বড় এই আর্থিক কেলেঙ্কারির ২০ বছর পর, আজও ঘটনার মূল হোতা হুন্ডি কাজলের ওপর মানুষের ক্ষোভ রয়ে গেছে।
কত ক্ষতি হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রিন্টু বলেন, 'আমি পরিমাণ বলতে চাই না। ক্ষতির পরিমাণ যদি ৫ লাখ টাকাও হয়, তা-ও আমার জন্য অনেক টাকা।'
টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো আশা নেই রিন্টুর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার টাকা চিরতরে হারিয়েছে বলেই মেনে নিয়েছেন তিনি।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক নজরুল ইসলাম—যিনি প্রতারিত টাকা উদ্ধারের জন্য গঠিত কমিটি 'লগ্নকারীদের টাকা উদ্ধার সংগ্রাম পরিষদ'র সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন, তিনিও কাজলের পঞ্জি স্কিমের আরেক পরোক্ষ শিকার।
নজরুল বলেন, 'আমি প্রথম এই কেলেঙ্কারির কথা শুনেছিলাম যখন বল্টু চিট নামের এক স্থানীয় ব্যক্তি আমাদের স্থানীয় শিক্ষক সমিতিতে থাকা অর্থ বিনিয়োগ করার বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অল্প সময়ের মধ্যেই এই টাকা দ্বিগুণ করে ফেরত দিতে পারবেন তিনি।'
নজরুল অবশ্য বিনিয়োগ করতে রাজি হননি এবং এর কিছুদিনের মধ্যেই ওই কথাবার্তা ভুলেও যান। এর কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি অন্যদের ওই স্কিমে টাকা দেওয়ার কথা শুনতে শুরু করেন।
'এই কাজে কেবল আমরা স্থানীয়রাই ছিলাম না। যশোর, খুলনা, ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গা থেকেও মানুষ এই উন্মাদনায় টাকা বিনিয়োগ করেছিল,' বলেন নজরুল।
টাকা হারিয়েছে কিনা জানতে চাইলে নজরুল উত্তর দেওয়ার আগে কিছুটা দ্বিধায় পড়েন।
তিনি বলেন, 'আমার ছেলে আমার স্ত্রী এবং আমার কাছ থেকে ৮০ হাজার টাকা নিয়েছিল। এই টাকাই আমরা হারিয়েছি।'
'দেখুন, কাজলের টাকা কোথা থেকে আসতো তা কেউ বলতে পারেনি। সে কি চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ছিল, নাকি সে ব্রিটিশ আমলে পোঁতা কথিত বজ্রনিরোধক সীমানা পিলার বিক্রি করেছিল? আমরা জানতাম না। মানুষ শুধু জানত, সে আপনার টাকা বাড়িয়ে দিতে পারবে এবং মানুষের শুধু টাকাই দরকার ছিল।'
'অনেকেই দ্রুত অর্থ উপার্জনের জন্য তাদের সমস্ত জমিজমা বিক্রির পাশাপাশি চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। তাই আমরা অপরাধীদের ধরতে এবং আমাদের টাকা ফেরত পেতে একটি কমিটি গঠন করি।'
'এবং আমরা তাদেরকে ধরেছিলামও। তবে আমাদের ভুল ছিল তাদের ছেড়ে দেওয়া। আমাদের উচিত ছিল তাদের সঙ্গে তখন সেখানেই বোঝাপড়া করে নেওয়া,' আরও যোগ করেন নজরুল।
অবশেষে ২০০১ সালে কাজলকে একটি আদালতে হাজির করা হলে, তাকে ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু এই রায় ভুক্তভোগীদের কাউকে সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
তার পক্ষে কাজ করা কথিত এজেন্টদের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজল এবং তার সহযোগীরা প্রচুর অর্থ সম্পদ অর্জন করেছে বলে জানা যায়। এই নেটওয়ার্কই শেষ পর্যন্ত তার পতনের কারণ হবে; কিন্তু এর আগে তাদের লোভের কারণে হাজার হাজার মানুষের জীবন নষ্ট হয়েছে।
আদালতের নথি অনুসারে, বেশ কয়েকটি ব্যাংকসহ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত অন্যরাও বিচারের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আজ অবধি কাজলের নাম তার নিজের এলাকার লোকেদের মধ্যে নেতিবাচকভাবেই উচ্চারিত হচ্ছে।
কিন্তু কে ছিলেন এই হুন্ডি কাজল? তিনি যা করেছেন তা কীভাবে করলেন? এসবের শুরু কোথায় হয়েছিল? আর কোথায়ই বা শেষ হলো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া খুবই কঠিন।
কাজল ও তার সজানো 'মিথ'
কাজল কখন থেকে লোকেদের তার প্রতারণার জালে জড়াতে শুরু করেছিল তা সঠিকভাবে জানা কঠিন।
স্থানীয়দের মতে, কাজল ছিলেন একজন নিরীহ মানুষ; নিজের এলাকায় দোকান চালাতেন তিনি। তার পরিবার ভারত থেকে এসে ঝিনাইদাহের কোটচাঁদপুরের সোলায়মানপুর গ্রামে তাদের পৈতৃক বাড়িতে বসতি গড়ে তুলেছিল।
স্থানীয় লাইব্রেরিতে একটি দোকান ছিল কাজলের; সেখানে তিনি স্টেশনারি সামগ্রী বিক্রি করতেন। প্রায় সবাই তাকে মনে রেখেছে; কেউ কেউ বিশেষ করে আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতার সময় তার লাইনম্যান হিসাবে কাজ করার দিনগুলো কোমলভাবে স্মরণ করে।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল রহমান মান্নান বলেন, 'কাজলের কথা বলার ধরন ছিল সত্যিই আকর্ষণীয়; মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারার ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে। আমাদের ফুটবল ম্যাচের সময় তিনি লাইনম্যান হতেন। সেই সময় তিনি ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কিংবদন্তি জিকোর মতো লম্বা ও কোঁকড়া চুলের স্টাইল করেছিলেন। আমরা সবাই তাকে বড় ভাই হিসেবে পছন্দ করতাম।'
স্থানীয়দের মতে, ৮০ এর দশকের শেষের দিকে নিজের দোকান চালানোর সময়, কাজল আরও একটি ব্যবসায়ের সুযোগ পেয়ে যান। তিনি দেখলেন, তখন কৃষকরা তাদের আখ স্থানীয় সরকারি সংস্থার কাছে বিক্রি করবে। তবে বিক্রির এই অর্থ তাদেরকে সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হবে না। তাৎক্ষণিকভাবে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে তাদেরকে একটি রশিদ দেওয়া হবে। এর ১০ থেকে ১৫ দিন পর তারা অর্থ পাবেন।
কিন্তু কৃষকদের অনেকেই বিক্রির সঙ্গে সঙ্গেই টাকা পেতে চেয়েছিলেন। এই সুযোগ নিয়ে কাজল তার মিষ্টি ভাষায় কৃষকদের বুঝিয়েছিলেন, কম দামে যেন তারা টাকার রশিদগুলো তার বিক্রি করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন কৃষক ৩ হাজার টাকা পাওনা থাকেন, এর বিপরীতে কাজল ২,৭০০ থেকে ২,৮০০ টাকায় রশিদটি কিনবেন। ফলাফল, রশিদ জমা দিয়ে টাকা নেওয়ার সময় কাজল সামান্য লাভ করতেন।
তবে সরেজমিনে, এটি সামান্য লাভ মনে হলেও কাজল জানতেন, তিনি যত বেশি রশিদ কিনবেন, তত বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবেন।
কিন্তু এর জন্য তার আরও পুঁজির প্রয়োজন ছিল এবং এ কারণেই তিনি লোকদের কাছে যেতে শুরু করলেন।
স্থানীয়দের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে এই ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে লাগলেন কাজল। তিনি ১ লাখ টাকার বিপরীতে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আকর্ষণীয় রিটার্নের প্রস্তাব দেন।
সহজে অর্থ বাড়ানোর সম্ভাবনা এবং কাজলের সঙ্গে অন্যদের সত্যি সত্যিই অর্থ উপার্জন করতে দেখে মানুষ প্রলুব্ধ হতে শুরে করে।
যদিও এই সময়ে টাকা আসছিল, কিন্তু কাজলের সক্ষমতা ছিল সীমিত। ঘটনার সঙ্গে পরিচিত স্থানীয়রা বলেন, এ সময় কাজল একটি পঞ্জি স্কিম তৈরি করতে শুরু করেছিলেন; এবং ধীরে ধীরে এর শীর্ষে উঠতে থাকেন।
একজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি আরেকজনকে দিতেন। এইভাবেই তিনি নিজের ক্লায়েন্টদের সন্তুষ্ট রাখতেন। এতে সামান্য বিলম্ব হলেও মানুষ বিরক্ত হতো না। কারণ কাজলকে এবং তার দেওয়া সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতিগুলো তারা বিশ্বাস করতেন।
ধীরে ধীরে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে; ফলে কাজল ঠিকঠাক মতো কাজ চালিয়ে নিতে কয়েকজন এজেন্ট নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এজেন্টরা স্কিমে আরও লোক নিয়ে আসার কাজ করতে শুরু করে।
তবে এজেন্টরা কত টাকা সংগ্রহ করছে বা দিচ্ছে তার হিসাব কোনো কাগজপত্রে উল্লেখ ছিল না। কিছু লোক তাদের নিজস্ব পঞ্জি স্কিমের ব্র্যান্ড নেইম হিসেবে 'হুন্ডি কাজল'র নাম ব্যবহার করতে শুরু করেন।
কাজলের সঙ্গে কখনও দেখা না হলেও তার ওপর ভরসা রেখে লাখ লাখ টাকা হাত বদল করেছেন বিনিয়োগকারীরা, এমনই ছিল তার খ্যাতি!
কখনও কখনও কাজলের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি, তারপেরও মানুষ এজেন্টদের কাছে এসেছে, যাতে তারা কাজলকে চিনতে পারে।
রত্না নামে কাজলের এক বিখ্যাত নারী এজেন্ট, আত্মসাৎ করা টাকা দিয়ে সোনার দিয়ে তৈরি বাড়ি গড়েছেন বলে গুজব ছিল। তিনি দিয়েছিলেন সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রস্তাব। ১ লাখে ১৪ হাজার টাকা রিটার্নের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি।
এমনও গুজব ছড়িয়েছিল যে, রত্না হুন্ডি কাজলের মেয়ে; যার পরিচয় গোপন করে রাখা হয়েছে। এবং এ কারণেই তাকে আকর্ষণীয় রিটার্ন অফার (সুদের হার) দেওয়া হয়েছিল, যা তিনি অন্যদের অফার করছিলেন। তিনি কাজলের মেয়ে হতে পারেন, এই গুজবই তার কাছে অন্য মানুষদের টেনে নিয়ে এসেছিল।
এক পর্যায়ে লোকজন তার কাছে ভিড় জমাতে শুরু করে।
কিন্তু রত্না যে কাজলের মেয়ে নন, তা অনেক পরে মানুষ জানতে পারে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, কাজলের বাড়িতে কয়েক বছর ধরে কাজ করার কারণেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
স্থানীয় ব্যবসায়ী খায়রুজ্জামান বলেন, 'এই গ্রামে আপনি যে বড় বাড়িগুলো দেখছেন, তার ৯০ ভাগই কাজলের টাকা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।'
বলা হয়, কাজলের এজেন্টদের ছেলেমেয়েদের সবারই আধুনিক মোটরসাইকেল ছিল এবং তারা যশোরের নামীদামী রেস্তোরাঁয় সকালের নাস্তা করতো।
ঝিনাইদহে তখন টাকার বৃষ্টি হচ্ছিল। শুধু এই বৃষ্টির ফোঁটা ধরার কায়দা জানলেই কেল্লা ফতে হয়ে যেত।
প্রতারণা ফাঁস হলো যেভাবে
নিজের জন্য চমৎকার এক তাসের ঘর দাঁড় করিয়েছিলেন কাজল। তবে আর সব তাসের ঘরের মতোই এই ঘরের ভেঙে পড়াও অবধারিতই ছিল।
সময় যত গেল, কাজলের টাকা নেওয়ার পরিমাণও বাড়তে লাগল। একসময় বিনিয়োগকারীরা অধৈর্য হয়ে উঠলেন। কাজলের প্রতারণার খবর চাউর হতে লাগল।
গণমাধ্যম খোঁজখবর নেয়া শুরু করলে কাজল এক দুঃসাহসী কাজ করে বসলেন। একটা সংবাদ সম্মেলন ডেকে বসলেন তিনি। এমনকি সংবাদ সম্মেলনের পর কয়েকজন সাংবাদিককে নিজের বিভিন্ন ব্যবসা ঘুরিয়েও দেখালেন।
হুন্ডি কাজলের টাকা সমস্যা নেই এবং শিগগিরই বিনিয়োগ ফেরত আসতে শুরু করবে—এই বার্তা দেয়ার জন্য তিনি এ কাজ করেছিলেন।
কিন্তু আরও অনেক ফাঁকফোকর থেকে গিয়েছিল।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০০ সালের গোড়ার দিকে ১২ কোটি টাকাভর্তি ব্যাগ নিয়ে পালানোর সময় কুখ্যাত এজেন্ট রত্না স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েন।
এ ঘটনায় সবার মনেই সন্দেহ জাগে, যতটা ভেবেছিলেন, কাজল বোধহয় অত সৎ লোক না।
সে সময় কাজল এলাকায় ছিলেন না। ওই মাসের ১৮ তারিখে তিনি ফেরেন। পরের মাসে কোটচাঁদপুরের এক বাসিন্দা কাজলসহ আরও ১৮০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এক আওয়ামী লীগ নেতাকেও আসামি করা হয়। অভিযোগ করা হয়, কয়েকটি ব্যাংক এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগে সাহায্য করে।
খবরটা শুনেই কাজল টাকা দেওয়ার কথা বলে কয়েকজন বিনিয়োগকারীকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি সভায় ডাকেন। সভা অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু বিনিয়োগকারীরা টাকা কখনও পাননি।
ব্যর্থ বৈঠকের পর ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা জাহিক ও তার এজেন্টদের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। অন্য কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও ভাঙচুর চালায় তারা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন দিন পর কাজলকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
পরে বিচারকার্যের জন্য তদন্ত শুরু হয়। ১৫-২০টি মামলা দায়ের করা হয় কাজলের বিরুদ্ধে। ২০০৭ সালের ৮ মার্চ কাজল জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে দেশ ছেড়ে পালান।
কোটচাঁদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মইন উদ্দিন বলেন, কোটচাঁদপুর থানায় কোনো মামলা বিচারাধীন নেই। তিনি বলেন, 'আমি যতদূর জানি, তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। কিন্তু ঠিক কোথায় থাকছেন, তা জানি না।'
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকায় কাজল কখনও দেশেও ফেরেননি বলে জানান তিনি।
কাজলকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও কিছু জানেন না বলে জানান মইন উদ্দিন।
কেউ কেউ বলেছেন, কাজল এখন চট্টগ্রামে থাকেন। অন্যরা বলেছেন, তিনি ভারতে আছেন।
কাজল যেন হাওয়ায় উবে গেছেন। তার সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে শত শত মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয়ও।
টাকার সন্ধানে
সোলায়মানপুরে আগের জায়গাতেই এখনও আছে কাজলের বাড়ি। যে-কাউকে জিজ্ঞেস করলেই চোখে-মুখে কৌতূহল ও গাম্ভীর্য নিয়ে পথ দেখিয়ে দেবে।
বেশ কয়েকটা মোড় পেরোনোর পর কাজলের বাড়ি। বাড়ির ফটকের রং উঠে গেছে। দোতলার কাঠামোটি রংবিহীন ইট দিয়ে তৈরি। উপরতলার জানালায় কাচ বা শার্সি কিছুই নেই।
ছাদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা রডগুলো বলে দিচ্ছে, বাড়িটির তৃতীয়তলা নির্মাণাধীন ছিল।
ঠিক বিলাসবহুল জীবনযাপনের ছাপ নেই বাড়িটিতে।
বাড়ির একতলা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ভবনের পাশেই একটি সরু গলি।
ওই গলিতে ঢুকলেই দেখা যাবে ভবনটা বেশ বড়, প্রায় ৯০০ বর্গফুট। সরু গলির শেষ মাথায় একটি ধাতব গেট। এখানে সাদা টাইলসের জায়গা নিয়েছে লাল ইট। এ-ই হলো কাজলের আসল চেহারা।
কাজলের প্রতিবেশীকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনিও সেই একই পুরনো কাহিনিই শোনাবেন।
ওই প্রতিবেশী কাজলকে টাকা দেননি, কিন্তু তার ছেলে তাকে [কাজলকে] এক টুকরো জমি দিয়েছিলেন। জমির পরিমাণ ঠিক কত, ওই নারী জানাতে পারেননি।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে তিনি খুব একটা আগ্রহী না। টাকা হারানোটাকে তিনি মন্দ বিনিয়োগ হিসেবেই দেখেন।
তিনি জানান, কাজলের পরিবার বাড়ি ছেড়ে খুব একটা বের হয় না। তারা থাকে উপরতলায়।
এই প্রতিবেদক দরজায় কড়া নাড়লে দরজা খুলে দেন কাজলের মেয়ে আঁখি আহমেদ রথী। তার বাবাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র নয় বছর।
এই বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঘটনা ভীষণ প্রভাব ফেলেছে পরিবারটির ওপর।
এই প্রতিবেদককে ভেতরে নিয়ে একটি সুপরিসর বসার ঘরে বসতে দিলেন। ঘরটির একসময়ের দামি আসবাব এখন সময়ের অত্যাচারে বিবর্ণ, জীর্ণশীর্ণ হয়ে এসেছে।
৩০ বছর বয়সি আঁখি প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। তিনি জানান, এর আগে কেউ তাদের গল্প শুনতে চায়নি।
আঁখি বলেন, 'টাকা শোধ করতে পারেননি বলে আমার বাবা এখন পালিয়ে আছেন। যদি টাকা ফেরত না দিলে কেউ তাকে ছাড়বে না।'
বাড়ির দেখাশোনা কে করেন, এ ব্যাপারে জানতে চাইল আঁখি বলেন, তার দুই ভাই ঢাকায় কাজ করেন—একজন পোশাক কারখানায়, অপরজন ঢাকার একটি এনজিওতে।
আঁখি গৃহিণী, যশোরের এক ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে।
ভবনের নিচতলা ১ হাজার ৬০০ টাকায় ভাড়া দিয়েছেন তারা। জমির ফসল থেকে পাওয়া অর্থ থেকেও কিছু আয় হয়।
'আমার বাবা আসলে ভারতীয়। ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি পরিবারের সাথে বাংলাদেশে আসেন।' এখনও অনেকে তাদের শরণার্থী বলে ডাকেন বলে জানান আঁখি।
তিনি বলছিলেন, 'আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন বাবা কেন বাড়ি আসেন না বুঝতে পারতাম না। এখন বুঝি। সব ঘটনায় পুরো পরিবার প্রভাবিত হয়েছে। আমার ভাইয়েরাও বাড়ি থেকে স্বাভাবিকভাবে বাইরে যেতে পারে না। এমনকি ঈদের নামাজের জন্য ঈদগাহেও যেতে পারে না। মানুষ আমাদের ভিন্ন চোখে দেখে।'
'আমার বাবা খুব ভালো মানুষ। কারণ মানুষ কাউকে বিশ্বাস না করলে তার হাতে টাকা দেয় না। এলাকায় আমার বাবা, চাচা এমনকি আমার দাদারও সুনাম আছে। তাদের কোনো বাজে রেকর্ড নেই।'
এলাকায় মানুষজনকে বাড়ি করতে, স্কুল নির্মাণে বা কবরস্থান ও শ্মশানের জন্য তার দাদা জমি দান করেছেন বলে স্মৃতিচারণ করেন আঁখি।
তার মতে, 'বাবা ব্যবসাটি শুরু করলেও, তিনি কোনো রেকর্ড রাখেননি। তাছাড়া অনেকে এজেন্ট হিসেবে কাজ করতো, সেটাও ছিল আরেক সমস্যা। কারণ তারা আমার বাবার কাছে টাকা জমা দিত না'
কাজলের ব্যাপারে কিছু অভিযোগ এখন বুঝতে পারেন আঁখি, কিন্তু পুরোপুরি ন্যায্য বলে মনে করেন না।
'এই এলাকার অনেক মানুষ আগে গরিব ছিল, তারা এখন ধনী হয়েছে। অনেকেই এই ঘটনার সুবিধাভোগী।'
আঁখির অভিযোগ, 'তারা যেকেনো মূল্যে আমার বাবার ফিরে আসা ঠেকাতে চায়। বাবা যেন ফিরে না আসেন সে জন্য তারা কিছু লোককে ঘুষও দেয়।'
সমস্ত টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য তার বাবার নেই বলেও দাবি করেন আঁখি। তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি হুন্ডি কাজল।
তার কন্যা বলছেন, বার্ধক্যজনিত সমস্যায় জর্জরিত কাজল এখন কলকাতার একটি ভাড়া বাড়িতে থাকছেন।
'চার বছর বাবাকে দেখিনি। বাবা এখন কিছু করেন না। তিনি একজন বুড়ো মানুষ, একা একা থাকেন। সেখানে তাকে দেখাশোনার কেউ নেই,' আঁখি বলছিলেন।
তিনি আরো জানান, দেশে ফিরে আসার কোনো ইচ্ছেই তার বাবার নেই।
'মেয়ে হিসেবে বাবা যে বেঁচে আছেন, তাতেই আমি খুশি। তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন সেটাই একমাত্র চাওয়া।'
কাজল দীর্ঘদিন ভালো মানুষ থেকে তারপর খলনায়কে পরিণত হয়েছেন নাকি তার শুরুর দিকের অন্ধকার অতীতও ধাপাচাপা দেওয়া হয়েছে, তা আসলে নির্ভর করে কে সেই প্রশ্নের উত্তরদাতা তার ওপর।
অনেক বছর পর আজো কোটচাঁদপুরে কাজলের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ রয়েই গেছে। প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা তাদের হয়রানি নিয়ে বলতে লজ্জা, সংকোচে ভোগেন।
বোকামি করার কারণেই কী তারা লজ্জিত? চা বিক্রেতা রিন্টুর বন্ধু; নাম না প্রকাশের শর্তে তার একটি সঙ্গত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন।
'কার কত টাকা গেছে—কেউ আপনাকে বলবে না। শুধু যে বোকামি করে ঠকার কারণে তারা লজ্জিত তা-ই নয়, তাদের এই বিনিয়োগ তাদের লোভকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আর কেউই নিজেকে লোভী স্বীকার করতে চায় না।'