অব্যবহৃত ল্যাপটপ, অযোগ্য শিক্ষক... যেভাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ
২০১২ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের ২৩ হাজার ৩৩১টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রোজেক্টর, মডেম ও স্পিকার পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলায় আরও উপযোগী করে গড়ে তুলতে আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৩০০ কোটি টাকা খরচ করে এসব ডিজিটাল ডিভাইস বিতরণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ২০১৮ সালে করা একটি সমীক্ষা অনুসারে এই প্রকল্পের সকরুণ অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে। এতে দেখা গেছে, আইসিটি শিক্ষকের গুরুতর সংকটের কারণে বিতরণ করা ৯৭ শতাংশ সরঞ্জাম অলস পড়ে আছে।
মোট ৪০ হাজার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার মধ্যে ২২ হাজার প্রতিষ্ঠানেই অন্তত একজন আইসিটি শিক্ষক না থাকার কথাও এতে উঠে আসে। বাদবাকি ১৮ হাজার প্রতিষ্ঠানে মাত্র একজন করে আইসিটি শিক্ষক রয়েছেন।
শিক্ষক সংকট প্রত্যাশিত ফলাফলকে ব্যাহত করতে থাকলেও ২০১৭ সালে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়কে বাস্তবায়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এতে ব্যাপক 'অনিয়মের' অভিযোগ ওঠার পর ২০২১ সালে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব এক তদন্তে নিম্নমানের ল্যাপটপ ও অন্যান্য ডিভাইস ক্রয়ের দিকটিও উঠে আসে।
সংশ্লিষ্ট কিছু সূত্রমতে, চরম শিক্ষক সংকটের বিষয়টি সমাধান না করেই এখন প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায়ের মেয়াদ বাড়ানোর কথা ভাবছে মন্ত্রণালয়।
একজন শিক্ষকের বিপরীতে ১,৮৪০ জন ছাত্র!
রংপুরের কারমাইকেল কলেজের একাদশ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী জানান, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১,৮৪০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র একজন আইসিটি শিক্ষক রয়েছেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের শিক্ষকরা শুধু পাঠ্যবই থেকে তাত্ত্বিক প্রোগ্রাম শেখান। কিন্তু আমরা ব্যবহারিক জ্ঞান পাই না।"
অথচ জাতীয় শিক্ষানীতি - ২০১০ অনুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
কারমাইকেল কলেজের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ড. মো. আমজাদ হোসেন টিবিএসকে জানান, শিক্ষার্থীদের যথাযথ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক আইসিটি পাঠদানের জন্য তার প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ৪ জন আইসিটি শিক্ষক প্রয়োজন।
কিন্তু অর্থনৈতিক, গণিত এবং অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষক যারা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, তাদেরই এখন আইসিটি ক্লাস নিতে হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও পুরোনো সিলেবাস
কর্তৃপক্ষের মতে, শিক্ষকদের মাত্র ৬-১২ দিনের সংক্ষিপ্ত আইসিটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে শুধুমাত্র মৌলিক কিছু বিষয় তারা শিখতে পারেন। এপর্যন্ত সারাদেশে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষক এ প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন, যাকে বিশেষজ্ঞরা শিক্ষাদানের জন্য একেবারেই 'অপর্যাপ্ত' বলে উল্লেখ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারপারসন প্রফেসর ড. লাফিফা জামাল টিবিএসকে বলেন, ক্লাসে পাঠদানের জন্য একজন শিক্ষকের কমপক্ষে ৬০ দিনের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। না হলে তিনি মানসম্পন্ন লেকচার দিতে পারবেন না।
"শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণেই দেশে মানসম্মত আইসিটি শিক্ষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক কীভাবে লেকচার দেন ও পরীক্ষাগারের সুবিধা ব্যবহার করে তা হাতেকলমে শেখান- প্রকৃতপক্ষে তার ওপর নির্ভর করে মানসম্মত আইসিটি শিক্ষা। একই সময়ে, সরকারকে অবশ্যই প্রতিটি স্কুলে সহায়ক সরঞ্জাম ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকার দিকটি নিশ্চিত করতে হবে"- যোগ করেন তিনি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সারাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব রয়েছে ৪,৫০০টি। ২০২৩ সালের মধ্যে আরও পাঁচ হাজার ল্যাব স্থাপিত হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায় ৬০ হাজার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমও স্থাপন করেছে, কিন্তু এগুলোর কোনো সুনির্দিষ্ট শিক্ষক নেই।
শিক্ষক ছাড়াও, গ্রামীণ এলাকায় উচ্চ গতির ইন্টারনেট এবং সঠিক ল্যাব সুবিধা নিশ্চিত করা এখনও বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।
এদিকে, ডিজিটাল সুবিধা পাওয়া রাজধানী ঢাকার শিক্ষার্থীরা বলছেন, পুরনো আইসিটি সিলেবাসে তারা সন্তুষ্ট নন।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের গ্রামার স্কুলের দশম শ্রেণির একজন ছাত্র আজওয়াদ ইউশা বলে, "তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি (আইসিটি) সিলেবাস দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় নতুন সফ্টওয়্যার এবং অন্যান্য আপডেট হওয়া প্রোগ্রামগুলি সম্পর্কে আমরা শিখতে পারছি না।"
"শিক্ষা মন্ত্রণালয় ডিজিটাল প্রযুক্তি, ডিজিটাল সাক্ষরতা, সোশ্যাল মিডিয়া সাক্ষরতা, প্রোগ্রামিং এবং কোডিং (সিলেবাসে) অন্তর্ভুক্ত করে না। অথচ এসব সম্পর্কে দক্ষতা একুশ শতকের ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় অনেক বেশি প্রয়োজন।"
সিলেবাস আধুনিকায়ন করতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের জ্ঞানসম্পন্ন যোগ্য শিক্ষক আবশ্যক, তবেই তারা ছাত্রদের তা শেখাতে পারবেন।
ক্রমবর্ধমান মানের ব্যবধান
২০১৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পরিচালিত একটি গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাত বার্ষিক স্থানীয় প্রযুক্তিগত কর্মীর চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) শিক্ষার্থী স্নাতক হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাত বার্ষিক সাড়ে ৭- ৮ হাজার নতুন প্রযুক্তিগত কর্মীর চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।
কারণ ৮০ শতাংশেরও বেশি চাকরিপ্রার্থী নিয়োগদাতাদের নির্ধারিত মান পূরণে ব্যর্থ হন বলে জানিয়েছে এডিবির গবেষণা।
টেস্টিং, ব্যবসায়িক বিশ্লেষণ এবং প্রকল্প পরিচালনার মতো মধ্য-স্তরের দক্ষতার জন্য দেশীয় প্রতিভা খুঁজে না পেয়ে শিল্পটি প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে জনবল উল্লেখযোগ্যভাবে উচ্চ বেতনে নিয়োগদানে বাধ্য হচ্ছে ।
এডিবির প্রতিবেদনে এই পরিস্থিতির জন্য সেকেলে এবং তত্ত্ব-কেন্দ্রিক শিক্ষার পদ্ধতি, সীমিত পরীক্ষাগার সুবিধা এবং পরীক্ষাগারে সীমিত সময়কে দায়ী করা হয়েছে।
আইসিটি গ্রাজুয়েটরা শিক্ষক হতে চান না
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদন অনুসারে, মানসম্পন্ন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা বেশি; যার প্রমাণ ৭৭ শতাংশ উচ্চ চাকরিতে তাদের নিয়োগের হার এবং বাংলাদেশে শীর্ষ নয়টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবিষয়ের স্নাতকদের চাকরিতে যোগদানের প্রাথমিক গড় মাসিক বেতন ৪০-৫০ হাজার টাকা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) থেকে স্নাতক করা আদনান হোসেনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, শিক্ষকতায় তার আগ্রহ আছে কিনা?
পড়াশোনা শেষ করা মাত্রই একটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ পাওয়া আদনানের মন্তব্য, শিক্ষকদের বেতন পর্যাপ্ত নয়, সমাজের অনেকে এখন শিক্ষকদের সম্মানিত হিসেবে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে চায় না।
আইটি খাতের সদ্য স্নাতক সম্পন্নকারীরা বলেছেন, শিক্ষক হতে তাদের অনিচ্ছার আরেকটি কারণ নিয়োগের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পড়াশোনা শেষ করেই একজন আইটি বা আইসিটির গ্রাজুয়েট চাকরি পেতে পারেন। কিন্তু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের চাকরি পেতে তাদের অন্তত ২-৩ বছর অপেক্ষা করতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিএসই স্নাতক টিবিএসকে বলেন, "আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১১ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করি। আকর্ষণীয় বেতনে এখন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি করছি। শিক্ষকতার চাকরিতে আমার আগ্রহী নেই।"
'সিস্টেম লসে'র পর ঘাটতি পূরণের পরিকল্পনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী টিবিএসকে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল সরঞ্জাম দেওয়ার আগে শিক্ষকদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সঠিকভাবে ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত ছিল। "আইসিটি শিক্ষক ছাড়া এরমধ্যেই আমরা একটি বিশাল সিস্টেম লস এর মধ্যে রয়েছি।"
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (কারিকুলাম) এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান টিবিএসকে বলেন, এই মুহূর্তে আমদের ন্যূনতম ৩০ হাজার যোগ্য শিক্ষক প্রয়োজন, রাতারাতি এসব নিয়োগ সম্ভব নয়। তাই আপাতত আমাদের বিকল্প শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করার উপর নির্ভর করতে হবে।
"তবে একথা সত্য মানসম্পন্ন আইসিটি শিক্ষার জন্য বিষয়-ভিত্তিক শিক্ষকেরই প্রয়োজন"- যোগ করেন তিনি।
সিলেবাস আধুনিকায়নের বিষয়ে তিনি জানান, বোর্ড এরমধ্যেই নতুন পাঠ্যসূচিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি, ডিজিটাল সাক্ষরতা, সামাজিক মিডিয়া সাক্ষরতা, প্রোগ্রামিং এবং কোডিং অন্তর্ভুক্ত করেছে।
"আমরা পাইলটিং ভিত্তিতে ৬২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নতুন সিলেবাস অনুসরণ করে আইসিটি ক্লাস শুরু করেছি। ক্লাস নিতে শিক্ষকদের ৩ মাসের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আমরা এসবের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করব এবং পরবর্তী উদ্যোগ নেব"- তিনি বলছিলেন।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি টিবিএসকে বলেছেন যে, তার মন্ত্রণালয় আইসিটি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। "আমরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা করছি। এ বিষয়ে আমরা আরও চিন্তাভাবনা করছি।"
"ইতোমধ্যে সিলেবাস রদবদল করা হয়েছে। আমরা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাবও স্থাপন করেছি।"