মূল্যস্ফীতির কারণে চিকিৎসা পেছাতে বাধ্য হচ্ছে রোগীরা
এক সপ্তাহ ডায়ালাইসিস করতে না পারলে শরীরে পানি জমে যায় রাজধানীর মণিপুরিপাড়ার বাসিন্দা মমতা বেগমের (৫৩)। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হলেও ছয় বছর ধরে সপ্তাহে দুইদিন নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতেন তিনি।
কিন্তু এখন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সন্তানদের পড়াশোনা ও সংসারের খরচ মিটিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন মমতা বেগমের স্কুল শিক্ষক স্বামী।
তাই কখনো সপ্তাহে একদিন ডায়ালাইসিস করছে আবার কখনো এক-দুই সপ্তাহ ডায়ালাইসিস বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
মমতা বেগম বলেন, টানা কয়েক সপ্তাহ ডায়ালিসিস করাতে না পারলে চলাফেরা করতে পারি না। তখন ধারদেনা করে আবার ডায়ালিসিস করাই। এভাবে আর কতদিন চলবে জানি না।
শুধু মমতা বেগম নয়, অর্ধ লাখের বেশি বেতন পাওয়া বেসরকারি চাকরিজীবী কুতুব উদ্দিন সংসার খরচ মিটিয়ে স্ত্রী ও মায়ের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এরইমধ্যে ঢাকায় ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে মেসে উঠেছেন।
কুতুব উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, টাকা যোগাড় করতে পারিনি, তাই আমার মা ও স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পারছি না
দ্রব্যমূ্ল্য বেড়ে যাওয়ায় মমতা বেগম ও কুতুব উদ্দিনের মত অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসা না করিয়ে রোগ পুষে রাখতে বাধ্য হচ্ছে।
নিজেদের চিকিৎসার ৬৮.৫০ শতাংশ ব্যয় মেটাতে হয় বাংলাদেশিদের। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ এই অর্থ ব্যয় করতে পারছে না।
২০ মে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান ২০২২ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ২৪ শতাংশ মানুষের পারিবারিক আয়ের ১০ শতাংশ চলে যায় চিকিৎসা খরচ মেটাতে। আর ৮ শতাংশের বেশি মানুষ পারিবারিক আয়ের ২৫ শতাংশের বেশি খরচ করে চিকিৎসার পেছনে।
রোগ পুষে রাখা বা দেরিতে চিকিৎসা নেয়ার কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যকর করা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর টাকা বাড়ানো ও স্বাস্থ্য বীমা চালু করার ওপর জোর দেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের (আইএইচই) অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ টিবিএস-কে জানান, সাধারণত দ্রব্যমূল্য বাড়লে মানুষ শুরুতে কম প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বাদ দিয়ে তারপর খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যয় কমায়।
"জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এখন মানুষ স্বাস্থ্য সেবা নিলে খাবারের ব্যয় কমাচ্ছে। এতে করে পুষ্টি ঘাটতি হচ্ছে। আবার খাবারের ব্যয় না কমালে রোগ পুষে রাখছে, দেরিতে চিকিৎসা নিচ্ছে।"
তিনি বলেন, উপজেলা-জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলোতে যে সেবা পাওয়া যায় তা কার্যকর করতে হবে, তাহলে মানুষের খরচ কম হবে।
"এছাড়া ক্যান্সার, কিডনি রোগসহ দীর্ঘমেয়াদী যে সব রোগের চিকিৎসা খরচ বেশি সে সব রোগের জন্য স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির টাকার (বয়স্ক বা বিধবা ভাতা) পরিমাণ বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে।"
বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী টিবিএস-কে বলেন, বাজেটে ওষুধে বরাদ্দ বাড়ালেও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ ব্যয় বাড়ানো গেলে নাগরিকদের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ কমানো সম্ভব।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য মো. আব্দুল আজিজ টিবিএস-কে বলেন, আমাদের দেশে চিকিৎসার জন্য কেউ আলাদা করে কোন অর্থ রাখেনা। তাই অসুস্থ হলে জমি, গরু বিক্রি করে দরিদ্র হয়ে যায়।
"এখন দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে ট্রায়াল বেসিসে কিছু এলাকায় স্বাস্থ্য বীমা চালু আছে। এটি সারাদেশে শুরুর বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে।"