বিস্ফোরণের পর ভয়ে দূরদূরান্তে পালিয়ে গিয়েছিলেন স্থানীয়রা
'রাত ৯টার দিকে দোকান বন্ধ করেছিলাম। বাসায় গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়েছিলাম। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এরপর আমার পরিবারের আট সদস্যকে নিয়ে দুই গ্রাম দূরে পালিয়েছিলাম।'
রোববার (৫ জুন) দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ আলী। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর পাশেই ছোট মুদির দোকান রয়েছে এই বৃদ্ধের। রাতের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের ভীতিকর পরিস্থিতি বর্ণনা করছিলেন তিনি।
মোহাম্মদ আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাসায় গিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমার বাসা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল ডিপো থেকে আধা মাইল দূরে। বিস্ফোরণের সময় ডিপোর একটি একটি সিলিন্ডার এসে আমার বাড়ির পুকুরে পড়ে। এরপরও বিস্ফোরণ হচ্ছিল। তাই জীবন বাঁচাতে ভয়ে দুই গ্রাম দূরে এক আত্মীয় বাড়ি গিয়েছিলাম। সকালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ফিরে এসেছি। জীবনে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি।'
শুধু আলী নন, রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের বিস্ফোরণের কম্পন অনুভূত হয়েছে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। বিভীষিকাময় এক রাত কাটিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুরো এলাকাজুড়ে রাসায়নিক পদার্থের অসহনীয় গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে আকাশ।
আগুনের আতঙ্কে মানুষ নিরাপদ স্থানের সন্ধানে ছুটতে থাকেন। রাত সাড়ে ৯টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলেও তার তীব্রতা তেমন ছিল না। রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের কারণে বিস্ফোরণে দমকল কর্মী এবং স্থানীয় বাসিন্দারা হতাহতের শিকার হয়েছেন। দমকল কর্মীসহ এ পর্যন্ত ৪৯ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।
ডিপোর পাশের এলাকা কেশবপুরে লোহার ডিপো রয়েছে মোহাম্মদ মামুনের। তবে তিনি থাকেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল বিএম কন্টেইনার ডিপোর পেছনের একটি এলাকায়। টিবিএসকে মামুন বলেন, 'বিস্ফোরণ হয় ডিপোর মাঝখানটায়। আর আমার বাসা ডিপোর পেছনে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এমন ভয়াবহ ছিল যে, আমার বাসার কাঠের বোর্ড ভেঙে যায়। সিলিং ফ্যান খুলে পড়ে যায়।'
শুধু তা-ই নয়, ডিপোর আশেপাশের এলাকার বিভিন্ন স্থাপনার কাচ ভেঙে পড়েছে। কেশবপুরের মসজিদের অ্যালুমিনিয়ামের দরজা এবং কাচ ভেঙে পড়ে গেছে। আশপাশে পার্ক করে রাখা ট্রাকের গ্লাসও ভেঙে গেছে।
আমার ছেলেকে এনে দে...
মাত্র ১৮ দিন আগে ছেলে শহীদুল এই কন্টেইনার ডিপোর পিয়ন হিসেবে চাকরি নেন। শনিবার (৪ জুন) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। 'আমার ছেলেকে এনে দে,' মা আয়েশা বিলাপ করতে করতে ছেলে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন ঘটনাস্থলের সবাইকে।
তিনি টিবিএসকেকে বলেন, 'আমার ছেলে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় কাজে গিয়েছিল। রাত সাড়ে ১০টায় এসে বাসায় রাতের খাবার খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আর আসেনি। তার বাবা তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলেও খুঁজেছে। না পেয়ে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।'
'আমার ছেলে সামনের বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। বাঁশখালীর চাম্বলে আমাদের বাড়ি। আমরা এখানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি,' যোগ করেন ছেলে খোঁজে পাগলপ্রায় আয়েশা।
তৌহিদুল হাসান নামে ডিপোর এক অপারেটরকে খুঁজে না পেয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে এসে সবার সাহায্য চাইতে থাকেন তার স্ত্রী তাসলিমা বেগম। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমার স্বামী ডিউটি শেষ করে বাসা এসেছিল রাতে। আগুন লাগার পর আমার কাছে ফোন আসলে আমি বের হয়ে পড়ি। এরপর আর পাওয়া যাচ্ছে না। আমার ভাইয়েরা শহরে থাকেন। তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খুঁজেছেন। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।'