বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনতে আদানি গ্রুপকে যে অর্থ দেবে তাতে বানানো যাবে ৩টি পদ্মা সেতু
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) আওতায় ভারতের আদানি গ্রুপকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ অর্থ ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিচ্ছে, তা দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু, নয়টি কর্ণফুলী টানেল বা চারটি মেট্রো রেলের মতো মেগা অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে।
১,৬০০ মেগাওয়াটের আদানি গোড্ডা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মেয়াদের ২৫ বছরে প্রায় ১১.০১ বিলিয়ন ডলার দেবে। বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট (বিডব্লিউজিইডি) ও ইন্ডিয়ান গ্রোথওয়াচ-এর প্রকাশিত এক যৌথ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনটির অন্যতম লেখক ও বিডব্লিউজিইডির সদস্য সচিব হাসান মেহেদী বলেন, 'কর্ণফুলী রিভার টানেলের বাজেটের তুলনায় [আদানি গোড্ডা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের] ক্যাপাসিটি চার্জের [বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া] পরিমাণ নয় গুণ বেশি এবং ঢাকা মেট্রো রেলের চেয়ে চার গুণ বেশি।'
২০১০-১১ সাল থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (আইআইপি) এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদেরকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে প্রায় ৮.৫৪ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)।
মেহেদী বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটা বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের যখন প্রায় ৬০ শতাংশ ওভার ক্যাপাসিটি আছে, তখন ভারত থেকে কয়লাবিদ্যুৎ আমদানির মানে হয় না।
২ জুন জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক নাগরিক আলোচনায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ অবশ্য দাবি করেন, দেশে বিদ্যুতের ওভার ক্যাপাসিটি নেই।
তিনি বলেন, ক্যাপটিভ পাওয়ার (নিজস্ব উদ্যোগে বিদ্যুৎ) ছাড়াও বিদ্যুতের মোট স্থাপিত সক্ষমতা প্রায় ২১ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু ডিরেটেড ক্যাপাসিটির ১০ শতাংশ এবং নির্ধারিত রক্ষণাবেক্ষণের ১০ শতাংশ বাদ দিলে সক্ষমতা দাঁড়ায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটে, যেখানে বর্তমান চাহিদা প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট।
আর ২০ শতাংশ স্ট্যান্ডবাই রিজার্ভ মার্জিন বিবেচনায় নিলে সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে দেখা যায়।
আদানি গ্রুপের সঙ্গে ২০১৭ সালের নভেম্বরে তাদের গোড্ডা কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বিনিময় ব্যবস্থার আওতায় ১,৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বিপিডিবি।
চুক্তি অনুযায়ী, ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বিপিডিবি প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টার জন্য ০.০৩৮ ডলার বা ৩.২৬ টাকা দিতে রাজি হয়েছে, যা বাংলাদেশের অন্য যেকোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি।
প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ কেনার জন্য অন্তত ৯.০৯ টাকা খরচ হবে, যা অন্যান্য আমদানি করা বিদ্যুতের চেয়ে ৫৬ শতাংশ বেশি এবং ভারতের সৌর বিদ্যুতের তুলনায় ১৯৬ শতাংশ বেশি।
বিডব্লিউজিইডি ও গ্রোথওয়াচের প্রতিবেদন অনুসারে, আদানি গ্রুপ প্রতি বছর ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে ৪২৩.২৯ মিলিয়ন ডলার নিতে পারে। কিন্তু এই অর্থব্যয় থেকে বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হবে না।
এর পাশাপাশি গোড্ডা আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ কেনার খরচ প্রতি বছর সাড়ে ৫ শতাংশ করে বাড়বে, যেখানে সৌর বিদ্যুতের খরচ বছরে ১০ শতাংশ হারে কমবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ভারত থেকে ১,১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে।
১,৬০০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটটি চলতি জুলাইয়ের মধ্যে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার কথা রয়েছে, আর দ্বিতীয় ইউনিটটি কার্যক্রম শুরু করবে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে।
কিন্তু ইন্দো-বাংলা সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে সংশ্লিষ্ট সঞ্চালন লাইন এখনও প্রস্তুত হয়নি।
বিপিডিবি সূত্র জানায়, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ পাবে না।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হলেও, বাংলাদেশকে মাত্র চার মাসে ১৪১.১০ মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।
রহনপুর থেকে মনাকষা সীমান্ত ৪০০ কিলোভোল্ট সঞ্চালন লাইনের প্রকল্প পরিচালক মো. মিজানুর রহমান সরকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রকল্পের বাংলাদেশ অংশের ভৌত কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু ভারত অংশে সঞ্চালন লাইনের কাজ এখনও শেষ হয়নি।'
মিজানুর রহমান অবশ্য বলেন, পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালন শুরু হবে।
কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জন্য উভয় দেশই ১৩৪ কিলোমিটার (বাংলাদেশে ৩০ কিলোমিটার ও ভারতীয় অংশে ১০৪ কিলোমিটার) সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছিল।