আজ ‘অপু’র জন্মদিন
প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আজ ৮৭তম জন্মদিন। একইসঙ্গে অভিনেতা, নাট্যকার, বাচিক শিল্পী এবং কবি তিনি। অভিনয় করেছেন আড়াইশোরও বেশি ছবিতে। বাংলার দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন 'অপু', 'ফেলুদা'র মতো কালজয়ী কিছু চরিত্রের মাধ্যমে।
সৌমিত্রর জন্ম ১৯৩৫ সালে কলকাতার মির্জাপুর স্ট্রিটে। হাইস্কুল থেকেই তার অভিনয় শুরু। নামকরা সব পরিচালকের সাথে কাজ করলেও সত্যজিতের সাথেই তার ঘনিষ্টতা ছিল বেশি। সত্যজিতের পরিচালনায় ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র।
সৌমিত্র–সত্যজিতের অভিনেতা–পরিচালকের রসায়ন বিশ্ব সিনেমার ক্যানভাসে তোশিবো মিফুনে–আকিরা কুরোসাওয়া, মার্সেলো মাস্ত্রিওনি–ফেদেরিকো ফেলিনি, রবার্ট ডি নিরো–মার্টিন স্করসিসি, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও–মার্টিন স্করসিসির কেমিস্ট্রির সঙ্গে তুলনা করা হয়।
সৌমিত্র বলেছিলেন, "সেই শৈশবকাল থেকে আজ অবধি অভিনয় ছাড়া অন্যকিছু ভাবিনি। অভিনয়টা সবসময় বুকের মধ্যে লালন করতাম। অন্য যা কিছু করেছি সবই ছিল ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ।"
নিজের অভিনয় শুরুর দিনগুলো নিয়ে তিনি নিজেই বলেছিলেন, "বাবা সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন। অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু তখন অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। সে কারণেই হয়তো বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত ছিলেন।"
"একান্ত নিমগ্নতায় বাবাকে অভিনয় আর আবৃত্তিটাই করতে দেখেছি। এ সব দেখেই এক সময় অভিনয় ও আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ বাড়ে আমার," বলেন তিনি।
সৌমিত্রের অসাধারণ প্রতিভা ও মনন নিয়ে বলে গেছে সত্যজিতও।
"সৌমিত্র নিজে থেকেই বুঝতে পারত আমি কী চাই," সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সত্যজিৎ।
তারই পরিচালনায় ১৯৫৯ সালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করেন 'অপুর সংসার' ছবিতে। অপু হয়ে-ওঠার জন্য সৌমিত্রকে ছবির চিত্রনাট্য দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তার আগে তিনি কোনও অভিনেতাকে চিত্রনাট্য দিতেন না। সঙ্গে দু'টি ফুলস্কেপ পাতায় লিখে দিয়েছিলেন অপু চরিত্রটি নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণে দেখা নিজস্ব ভাবনা। পাশাপাশি সৌমিত্রও লিখেছিলেন 'অপুর ডায়েরি' এবং অপু সম্পর্কিত নিজের অভিজ্ঞতায় ভর-করা কল্পনা।
এরপর ১৯৭৩ এ তিনি অভিনয় করেন 'অশনি সংকেত'-এ। ছবির শুটিংয়ের আগেই বীরভূমের গ্রামে হাজির হয়েছিলেন সৌমিত্র ও সত্যজিৎ। সত্যজিৎ গিয়েছিলেন নিজের অভ্যাসবশত লোকেশন খুঁটিয়ে দেখতে। আর সৌমিত্র নিজের নোটবুকে নানা ধরনের নোট নিচ্ছিলেন। গ্রামের লোকের 'কমন ম্যানারিজম', কীভাবে তারা হাঁটে, কাঁধে গামছা রাখে, উবু হয়ে বসে ইত্যাদি। সঙ্গে নিজের কিছু চিন্তাভাবনাও লিখে রাখছিলেন। যা একজন অভিনেতার কর্মপদ্ধতির পরিচয় দেয়। পরিচয় দেয় মানসিকতারও।
আড়াইশোরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র । এরমধ্যে রয়েছে 'সাত পাকে বাঁধা', 'ক্ষুধিত পাষাণ', 'ঝিন্দের বন্দী', 'একটি জীবন', 'কোনি', 'হীরক রাজার দেশে', 'দত্তা', 'চারুলতা'র মতো কালজয়ী ছবি।
নায়ক হিসেবে তিনি তাঁর সমসাময়িক সব নায়িকার বিপরীতেই সাফল্য পেয়েছেন। সম্ভবত তাই তেমন করে কারও সঙ্গে 'জুটি' গড়ে উঠেনি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে 'সাত পাকে বাঁধা', 'দত্তা' ছবিতে সৌমিত্র হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। তেমনই সাবিত্রী, সুপ্রিয়া, অপর্ণারাও সৌমিত্রের সঙ্গে মিশেছেন অবলীলায়।
১৯৬১ সাল সৌমিত্রের অভিনয় জীবনে মাইলফলক। ওই বছরই মুক্তি পায় তপন সিনহা পরিচালিত 'ঝিন্দের বন্দী'। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সেই ছবিতে সৌমিত্রকে দর্শক প্রথম পেয়েছিলেন একটি খলচরিত্রে।
যে অভিনেতা 'অপু' হিসেবে দর্শকের মনে জায়গা করে নিয়েছেন, 'ক্ষুধিত পাষাণ', 'দেবী' বা 'সমাপ্তি'-তে যে নায়ক ঝড় তুলেছেন, সেই অভিনেতাকে তপন সিন্হা দিলেন এক নিষ্ঠুর ভিলেনের চরিত্র। এমন একটি চরিত্রে সৌমিত্রকে যে কেউ ভাবতে পারেন, সেটাই ছিল আশ্চর্যের।
তরুণ বয়সে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা সৌমিত্র পিছিয়ে থাকেননি শেষ বয়সেও। ২০১৫ সালে শিবপ্রসাদ মুখার্জি ও নন্দিতা রায়ের পরিচালনায় তিনি অভিনয় করেন 'বেলাশেষে' সিনেমায়।
১৯৮৪ তে 'ঘরে-বাইরে' ছবিতে জুটি বাঁধা স্বতীলেখা সেনগুপ্তের সাথে এতবছর পর আবারও পর্দায় আসেন সৌমিত্র। বয়স্ক এক দম্পতির ভালোবাসার উপাখ্যান দেখানো এই ছবিটিও জায়গা করে নেয় দর্শকের মনে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অর্জনের খাতাও বেশ বড়। ২০০৪ সালে 'পদ্মভূষণ', ২০০৬ সালে 'পদক্ষেপ' ছবিতে জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত সৌমিত্র ২০১১ সালে ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মান 'দাদাসাহেব ফালকে' পান। ঘটনাচক্রে, তার ছয় বছর পর ২০১৮ সালে তিনি ভূষিত হন ফরাসি সরকারের সেরা নাগরিক সম্মান 'লিজিয়ঁ দ'নর'-এ।
গুনী এই অভিনেতা ২০২০ এর ১৫ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু রেখে যান অসংখ্য স্মৃতি ও কালজয়ী কিছু চরিত্র।
সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা