ঋণের টাকায় ফ্ল্যাট-বাড়ি: সম্পদ নাকি দায় বাড়ানো
ঋণ করাকে কখনো উৎসাহিত করা হয়নি কোনো সমাজে, পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়া। কোন অর্থনীতির সামগ্রিক ব্যয় কত হবে তা নির্ধারিত হয় সামগ্রিক আয় ও ঋণ প্রবাহের মাধ্যমে। ধরুন, আপনার আয় ৫০ হাজার টাকা, আর ঋণ নেওয়ার সুযোগ ৫০ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে আপনি ১ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে পারেন। আপনার ৩ লাখ টাকার ঋণসীমাসহ একটা ক্রেডিট কার্ড থাকলে আপনি পুরো ঋণের টাকাটাই খরচ করতে পারছেন, সঙ্গে আপনার আয় তো রয়েছেই। ঋণ যদি আপনার জন্য খারাপও হয়, তবু সেটা আপনার ভোগ নিশ্চিত করে; যদিও পরে সুদসহ পরিশোধ করতে হয়।
আমরা জানি, ঋণগ্রস্ত মানুষ খুব অশান্তিতে দিন কাটায়। কথায় বলে, ঋণমুক্ত মানুষেরা সুখী মানুষ। কথাটি অমূলক নয়। যারা ঋণের জালে একবার আবদ্ধ হয়ে মুক্ত হতে পারেন, তারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। তবে ঋণ যেমন মানুষকে ভগ্নপ্রায় করে তোলে, সর্বস্বান্ত করে দেয়; ঠিক তেমনি আবার উপকার করতেও পারে।
ঋণ কী জন্য, কখন, কোথা থেকে, কী শর্তে নেওয়া হচ্ছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেউ যদি শুধু ভোগের জন্য বা অহেতুক অনুৎপাদনশীল খাতের জন্য ঋণ নেন, তাহলে সেটি তার সাময়িক প্রয়োজন মিটাবে হয়তো; কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে উপকারের চেয়ে অপকার করবে বেশি। কিন্তু কেউ যদি ঋণ নিয়ে সেটাকে ব্যবহার করে টাকা বাড়াতে পারেন এমনভাবে, যে, ঋণ সুদসহ শোধ করার পরেও হাতে কিছু টাকা থাকে, তাহলে সেই ঋণ মন্দ নয়।
ঋণগ্রহীতাকে ভালো ঋণ ও মন্দ ঋণ বুঝে ঋণ নিয়ে ব্যবহার করতে হবে। এই ক্ষেত্রে দরকার আর্থিক জ্ঞান। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, ঋণের মতো কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করার আগেই একজন মানুষের আর্থিক বিষয়ে সম্যক জানাশোনা থাকা জরুরি। বিশেষ করে পারসোনাল ফাইনান্স বিষয়ে।
কোথা থেকে এই জ্ঞান আপনি অর্জন করবেন? দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে করপোরেট ফাইন্যান্স শেখায়; কিন্তু পারসোনাল ফাইনান্স শেখানোর জন্য কোনো কোর্স নেই এখনো। তাই এই জ্ঞান অর্জনের জন্য আপনাকে নিজে উদ্যোগ নিয়ে শিখতে হবে। আপনার প্রথম যে বিষয় বুঝতে হবে, তা হলো- ইনকাম স্টেটমেন্ট এবং ব্যালান্স শিট। কোনো কোম্পানির ইনকাম স্টেটমেন্ট ও ব্যালান্স শিট থেকে এটা একটু ভিন্নভাবে আপনার কাছে ধরা দিতে পারে। কারণ, আলোচ্য বিষয় করপোরেট ফাইনান্সের মতো নয়; একটু আলাদা।
ইনকাম স্টেটমেন্টে থাকে প্রধানত দুটো দিক। আয় ও ব্যয়। আয় মানে যে টাকা আপনার হাতে আসছে। আর ব্যয় মানে যে টাকা আপনার হাত থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। ধরুন, আপনি চাকরি করেন। যে টাকা বেতন পান, সেটা আপনার আয়। আপনি যদি সঙ্গে কিছু বাড়িভাড়া পান, সেটাও আপনার আয়। এইভাবে যে টাকা আপনার কাছে আসছে, সেটা আপনার মোট আয়; এর মধ্যে সুদ আয়ও থাকতে পারে । আর যে টাকা আপনার কাছ থেকে চলে যাচ্ছে, সেটা আপনার ব্যয়। ধরুন, আপনার খাবার খরচ, বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ খরচ, গাড়ি ভাড়া ইত্যাদি যত খরচ সব ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত। আপনি যদি কোনো টাকা জমান ভবিষ্যতের জন্য বা কাউকে ঋণের সুদ হিসাবে দেন, সেটাও বর্তমানের ব্যয়।
আর ব্যালান্স শিট হচ্ছে আপনার অ্যাসেট ও লায়াবিলিটির (সম্পদ ও দায়) হিসাব বিবরণী। একটু ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, অ্যাসেট হচ্ছে এমনকিছু- যা আপনাকে আয় বা ইনকাম দিবে; অর্থাৎ আপনার ইনকাম স্টেটমেন্টে আয়ের সঙ্গে নতুন ক্যাশ যোগ করবে যা, সেটাই হচ্ছে অ্যাসেট। দায় হচ্ছে ঠিক তার বিপরীত। দায় বা লায়াবিলিটি আপনার আয়ের থেকে কিছু অংশ কেটে নিয়ে যাবে। যেমন ধরুন, আপনার ব্যাংকে কিছু টাকা আছে যা থেকে আপনি সুদ বা মুনাফা পান। ওটা আপনার অ্যাসেট বাড়াতে সাহায্য করছে। যখন সুদ দিচ্ছেন, তখন আপনার অ্যাসেট কমে যাচ্ছে।
এবার ধরুন, আপনি একটা ফ্ল্যাট কিনবেন বলে মনস্থির করলেন। ভালো বেতনের চাকরি করেন, একটা ফ্ল্যাট না কিনলে কিভাবে হয়! অনেকের ফ্ল্যাট হয়েছে, পরিবারের পক্ষ থেকে একটা প্রচ্ছন্ন চাপ আছে। তাছাড়া আপনি বাড়ি ভাড়া দিতে চান না; মালিক হতে চান।
আপনি একটি ফ্ল্যাট পছন্দ করলেন, দাম এক কোটি টাকা। আপনার কাছে বিশ লক্ষ টাকা আছে। প্রয়োজন আরও ৮০ লক্ষ টাকা। রেজিস্ট্রি করতে আরও ৭ থেকে ৮ লক্ষ টাকা। আপনি একটি ব্যাংকের কাছ থেকে ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য ঋণ নিলেন ৮০ লক্ষ টাকা। এই ঋণ আপনি নিলেন ১৫ বছর মেয়াদী। ধরুন, মাসিক কিস্তি ৮০ হাজার টাকা। এই ঋণের বোঝা আপনাকে ১৫ বছর ধরে পরিশোধ করে যেতে হবে। আপনি যদি এই ফ্ল্যাট ভাড়া দেন, দেখবেন ৩৫ হাজার টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু আপনার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে ৮০ হাজার। তাছাড়া আপনি ওই ফ্ল্যাট যেহেতু কিনেছেন, ওর সাজসজ্জার পেছনে একটা বাড়তি খরচ হবে, নতুন আসবাবপত্র কিনতে হবে। এসব মিলে আরও ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা আপনার হাত থেকে বেরিয়ে যাবে।
আপনি হয়তো এখন ২০ হাজার টাকা ভাড়া দেন থাকার জন্য। আপনি চাইবেন নিজের ফ্ল্যাটে উঠতে। কে চায় ভাড়া বাসায় থাকতে! আপনি উঠলেন নিজের বাসায়। জমা টাকা সব শেষ আরও ব্যক্তিগত ঋণ হলো; কারণ নিজের টাকা তো চলে গেছে ডাউন পেমেন্ট দিতে।
তাহলে নতুন বাসায় উঠলেন, নিজের বাসায় মাথা গুঁজলেন বটে; কিন্তু আপনার গলা পর্যন্ত ঋণ- প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ ও ব্যক্তিগত ঋণ। আপনার টাকা বাঁচল ২০ হাজার; কিন্তু ঋণের কিস্তি হলো ৮০ হাজার। এই কিস্তি আপনাকে ১৮০ মাস ধরে দিতে হবে। যদি কোনো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন, তাহলে পেনাল সুদ গুনতে হবে।
আপনার মনে খুব প্রশান্তি। আপনি নিজে ফ্ল্যাট কিনে তাতে উঠেছেন; কিন্তু হিসেব করে দেখেছেন কি ফ্ল্যাট নামক ওই অ্যাসেট আসলেই আপনার সম্পদ নাকি দায়? সত্যি কথা বলতে, ওটা সম্পদ হয়নি; বরং আপনার ভোগান্তি বাড়িয়েছে; আপনার জীবনকে খাঁদের কিনারে দাঁড় করিয়েছে। যদি আপনার অন্য কোনো আয়ের ক্ষেত্র না থাকে, তাহলে আপনি বিপদের মধ্যে অবস্থান করছেন। এমন যদি হতো, ফ্ল্যাট থেকে টাকা আপনার অ্যাসেট বাড়াচ্ছে, অর্থাৎ আপনি যে ফ্ল্যাট কিনেছেন তার ভাড়া আপনার মাসিক ইনস্টলমেন্টের চেয়ে বেশি, তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু আমাদের দেশের সেই অবস্থা আমরা দেখি না। তাই এটা সম্পদ হয়ে ওঠে না; দায় হয়ে যায়।
তার মানে কি আমি ফ্ল্যাট কিনতে নিরুৎসাহিত করছি? না; মোটেও না। আপনি অবশ্যই ফ্ল্যাট কিনবেন, বাড়ি বানাবেন; তবে সেটা নিয়ে আপনাকে হোমওয়ার্ক করতে হবে, খাতা কলম নিয়ে। আপনার কেনার সক্ষমতা আছে কি না, দেখে নিবেন। নিজের ইকুইটির অংশ বাড়াতে হবে। ফ্ল্যাটের মোট খরচের শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ নিজের বিনিয়োগ থাকতে হবে। আপনার সুযোগ ব্যয় সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে; হিসেব নিকেশ করতে হবে। তারপর এই সিদ্ধান্ত নেবেন।
কিস্তি সহনীয় হতে হবে; না হলে সারাক্ষণ ওই কিস্তি পরিশোধ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। আর অ্যাসেট কিনছেন নাকি দায় কিনছেন, সে সম্পর্কে ভালো ধারণা নিতে হবে। নিজে যদি না বোঝেন, বিশেষজ্ঞ কারও সঙ্গে বসে ঠিক করে নেবেন, হিসেব বুঝে নেবেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন। তাহলে বিপদে পড়বেন না।
তবে সহজ কথায় মনে রাখবেন, ফ্ল্যাট কিনে আপনি কি স্বস্তিতে আছেন নাকি অস্বস্তিতে পড়েছেন? যদি অস্বস্তিতে পড়ে থাকেন, তাহলে আপনি দায় কিনেছেন, দায় বাড়িয়েছেন।
ফ্ল্যাট আপনার অন্য খরচ উসকে দিতে সক্ষম। আপনি যেহেতু ভালো একটা চাকরি করেন, ব্যাংক বা লিজিং কোম্পানির লোকজন আপনাকে সারাক্ষণ অনুরোধ করবে একটা ভালো মডেলের গাড়ি কেনার জন্য। আপনিও ভাববেন, আয় ভালো, একটা ফ্ল্যাট আছে, এবার একটা গাড়ি হলে ভালো হবে। জীবন আরামে চলবে, লোকজনের কাছে নিজের ভাবমূর্তি একটু বাড়বে; কারণ, এই সমাজ তো প্রদর্শন প্রভাবে ন্যুব্জ। আপনি অল্প কিছু ডাউন পেমেন্ট দিয়ে কিনলেন একটা সুন্দর গাড়ি, একটা ড্রাইভার নিলেন; কারণ ঢাকা শহরে গাড়ি রেখে কোথাও যাওয়ার অবস্থা নেই, চুরি হয়ে যাবে। নিজের ফ্লাটের গ্যারেজে রাখলেন, গাড়িটি ভালো করে সাজালেন, যেমন অনেকে কোরবানির গরু সাজায়! তারপর দেখলেন, জীবনে একটু আরাম যোগ হয়েছে।
আপনাকে দেখে সবাই ভাবে, আপনি একটা গাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিক। অনুভবটা খুব সুখের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আপনি আবারও ৫ থেকে ৬ বছরের জন্য অন্য আরেকটা ঋণের জালে আটকা পড়লেন।
তাহলে কি আপনি গাড়ি কিনবেন না? অবশ্যই কিনবেন; কিন্তু নিজের বিনিয়োগ বেশি হতে হবে। আর ফ্ল্যাট কেনার সময় যে পরামর্শগুলো নিয়ে কথা বলেছি, সেগুলো মনে রাখতে হবে। যদি সব বিবেচনায় মনে হয় ঠিক আছে, তাহলে আপনি কিনবেন।
জীবন আপনার, আয় আপনার, ব্যয় করার বিষয়টিও আপনি ঠিক করবেন। বড় কোনো খরচে যাওয়ার আগে ভাববেন, ঋণ নেওয়ার সময় ভাববেন। কারণ, ঋণের সঙ্গে সুদ আছে এবং সেটা দীর্ঘ সময় ধরে বহন করতে হবে। যদি মাঝপথে বিপদ হয়, আয় না থাকে, চাকরি চলে যায়, অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন কী করবেন- সে ভাবনাও ভাবতে হবে কেনার আগে।
সবচেয়ে বড় কথা, আপনি কি সম্পদ ক্রয় করছেন নাকি দায় ক্রয় করছেন- সে ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে; ইনকাম স্টেটমেন্ট এবং ব্যালান্স শিটে কী প্রভাব পড়ছে- সেটা ভাবতে হবে।
সতর্ক থাকলে অনেক বিপদ থেকে মুক্ত থাকা যায়- এটা জ্ঞানী মানুষেরা মনে করেন।
- লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল