করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে আশার রেখা
অনেক বিজ্ঞজন ও অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এই বছর কোনোভাবে চললেও পরবর্তী বছরে দেশে একটা ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। এমনকি দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে; মানুষ না খেয়ে মারা যেতে পারে। আমার মনে হয়, এই কথার কোথাও একটু ভুল আছে। সরকার বলছে, দেশে পর্যাপ্ত খাবার মজুদ আছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও তেমন নেই।
যদিও করোনাভাইরাস আছে তার সমস্ত দম্ভ ও শক্তি নিয়ে, মানুষকে আক্রান্ত করছে প্রতিদিন, অনেক মানুষকে আটকে রেখেছে ঘরের মধ্যে- যা পৃথিবীর মানুষ এই মহামারির আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি; তবু বাংলাদেশের মানুষ শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াবে, আবার হাসবে, সবাই একত্রে বসবাস করবে এবং মোট কথা, না খেয়ে কেউ মারা যাবে না- দৃঢ়ভাবে এই আশাবাদ প্রকাশ করতে চাই।
অর্থনীতির সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি
বাংলাদেশের অর্থনীতি যে গতিতে সামনে যাচ্ছিল, তা অনেকের কাছেই ছিল অনুকরণীয়। এটি সমগ্র পৃথিবীর কাছে একটি উন্নয়ন বিস্ময়। কিন্তু করোনা মহামারি আমাদের অর্থনীতির চাকাকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। শুধু আমাদের নয়, সারা পৃথিবীকে দাঁড় করিয়েছে এমন এক বাস্তবতায়, মানুষের সমস্ত ক্ষমতা এখন ম্রিয়মান হয়ে গেছে অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশ এ বছর বড়জোর ২-৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। কেউ কেউ বলছে, প্রবৃদ্ধি একেবারে নাও হতে পারে। যদিও সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না, সব অনুমান-নির্ভর; কারণ, কেউ জানে না কবে শেষ হবে এই মহামারি।
আমরা জানি, আমাদের অর্থনীতির প্রধান খাত তিনটি- সেবাখাত, শিল্পখাত ও কৃষিখাত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০০১-২০০২ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ২০ শতাংশ, শিল্পের অবদান ২৩.৮ শতাংশ এবং সেবাখাতের অবদান ৫৬.২০ শতাংশ- যা ২০১৮-২০১৯ সালে দাঁড়িয়েছে কৃষিতে ১৩.৭ শতাংশ, শিল্পে ৩৪.৪ শতাংশ এবং সেবাখাতে ৫১.১৯ শতাংশ। গেল বছর আমাদের রেমিটেন্স আয় হয়েছে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
উল্লেখ্য, পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত ১০ বছরে আমাদের দেশে প্রায় এক কোটি মানুষ হতদরিদ্র অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশে হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৮ লাখ। ২০১৯ সালের জুন মাস শেষে অতি গরিব বা হতদরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখের কিছুটা বেশি। বাংলাদেশে এখন ১৭ কোটির কাছাকাছি জনসংখ্যা রয়েছে। সব মিলিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে সোয়া ৩ কোটি মানুষ।
বিবিএস-এর জুন ২০১৯ সালের হিসেবমতে, জুন মাসের শেষে দেশের দারিদ্র্য হার সাড়ে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৮ সালের জুন মাস শেষে এই হার ছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। গত জুন শেষে অতি দারিদ্রের হার নেমেছে সাড়ে ১০ শতাংশে। এক বছর আগে এর হার ছিল ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। অনেকে আশঙ্কা করছেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪০ শতাংশের কিছু বেশি হয়ে যেতে পারে এবং হতদরিদ্রের হারও সেই হারে বেড়ে ২০ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে।
আইএলও তথ্যভান্ডার মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ২৫ লাখ। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৫৮ শতাংশ কর্মসংস্থান ছিল নাজুক। আনুষ্ঠানিক চুক্তিহীন কাজকে আইএলও নাজুক শ্রেণিতে ফেলে, আর ওই শ্রেণিতে পড়েন সাধারণ দিনমজুর, গৃহকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। এদিকে বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫-৯০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক।
তাছাড়া আমাদের অর্থনীতিতে বেকারত্বের হার ৪.২৯ শতাংশ (২০১৯)। তার সঙ্গে প্রতি বছর ২০-২২ লাখ শিক্ষিত বেকার যুক্ত হচ্ছেন এই তালিকায়। দেশের বাইরে কাজ করেন প্রায় এক কোটি মানুষ। তাদের মধ্যে কয়েক লাখ দেশে ফিরেছেন, অনেকেই চাকরি হারিয়ে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। এরা আবার শিগগিরই সেসব দেশে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না। করোনা-সৃষ্ট মহামারি বাংলাদেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মোট কর্মজীবী মানুষের বড় একটা অংশকে কর্মহীন করে ফেলেছে।
উপরে উল্লেখিত সব তথ্য করোনা-পূর্ববর্তী। ক্ষতির গভীরতা অনেক বেশি হলেও প্রকৃত তথ্য কেউ এখন দিতে পারবেন না; কারণ কেউ জানেন না এই সমস্যা কতদিন থাকবে। তবে বেকারত্ব বাড়বে, দারিদ্র বাড়বে, ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হবে, মানুষের আয় কমবে, সামগ্রিক ব্যয় কমবে, রপ্তানি আয় কমবে, আমদানি ব্যয় কমবে এবং সার্বিকভাবে দেশের প্রবৃদ্ধি কমবে- তাতে কারও সন্দেহ নেই। তাহলে আমাদের আশার জায়গাটা কোথায়, সেটা নিয়ে কথা বলা জরুরি।
আমাদের আশার কথা
বিশ্বের অনেক দেশে মৃত্যুহার কমে আসার কারণে লকডাউন ক্রমাগতভাবে উঠে যাচ্ছে। বাংলাদেশও সেই পথে হাঁটছে। তাছাড়া আস্তে আস্তে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু না হলে বিপদ দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তবে শুধু সরকার নয়, দেশের সব মানুষের নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে যথাযথভাবে, শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে, কাজ করতে হবে।
সূত্রমতে, বাংলাদেশে বার্ষিক ধান উৎপাদন হয় ৩৭৫ লাখ মেট্রিক টন। মোটামুটিভাবে ধান উৎপাদনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩.২%। মাথাপিছু চাল গ্রহণের দৈনিক পরিমাণ ১৯৯৫-৯৬ সালের জরিপে ৪৬৪.৩ গ্রাম থেকে ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৬৭.২ গ্রামে। জনসংখা যদি ১৭ কোটিও ধরি, তাহলে বছরে চালের চাহিদা ২২৭ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়ায়।
দেশে খাদ্যশস্য তথা চাল, গম, ভুট্টা মিলে উৎপাদন প্রায় ৪১৫ লাখ মেট্রিক টন। তার সঙ্গে আলুর উৎপাদন প্রায় ১০০ লাখ টন, মাছ ৪৫ লাখ টন, মাংস ৬২ লাখ টন, আরও আছে ডিম, দুধ, ফল ও শাকসবজি ইত্যাদি। অন্যদিকে চালের গড় মাসিক চাহিদা ২১ লাখ টন এবং বছরে ২৫২ লাখ টন। এবার ফলন নষ্ট হয়নি, কৃষক তার ধানের সিংহভাগ ঘরে তুলতে পেরেছেন। তাহলে মোটামুটি হিসেবে খাদ্য ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।
বাংলাদেশের প্রধান শিল্প তৈরি পোশাক। এই খাতে প্রায় ৪১ লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ধরলে আরও কয়েক লক্ষ লোক এই খাতের সঙ্গে জড়িত। লকডাউন শিথিল করে তারা সীমিত পরিসরে কাজ শুরু করেছেন। যদি দেশে রোগ সংক্রমণের হার অতিমাত্রায় না বাড়ে, তাহলে জুন মাসের মধ্যে ৮০-৯০ শতাংশ কারখানা খুলে যাবে। তার ফলে আয় প্রবাহ শুরু হবে।
তার সঙ্গে সরকারি প্রণোদনার টাকাও বাজারে ঢুকে যাবে, পরিবার প্রতি যে ২৫০০ টাকা সরকারি ক্যাশ প্রণোদনা, সেটাও মানুষের হাতে যাবে; স্বল্পমূল্যে রেশনিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে, ফলে মানুষের ব্যয় বাড়বে ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হলে পণ্যের বণ্টন স্বাভাবিক হয়ে আসবে, তার প্রভাব পড়বে দামের ওপর, ভোগের ওপর। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কষ্ট কমে আসবে।
সেবাখাতের অবস্থাও আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। অনেকের চাকরি চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেকেই কষ্টে পড়বেন। এটা শিল্পের ও ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রেও হবে। তবে ব্যাংকে বিদেশি টাকার প্রবাহ তৈরি হবে। যতদূর জানি, আইএমএফের কাছে ৭৬০ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের কাছে ৫০০ মিলিয়ন এবং এডিবির কাছে ৫০০ মিলিয়ন সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আইএমএফের কাছে করোনার কারণে ব্যালান্স অব পেমেন্ট সহায়তা হিসেবে সুদ ছাড়া আরও ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
যেখানে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার সুযোগ আছে, সেখানে আবেদন করতে হবে। বাংলাদেশের রিপেমেন্ট করার ইতিহাস বেশ ভালো। সুতরাং ঋণ পাওয়া যাবে। এই ঋণের প্রবাহ হলে দেশের তারল্য কমে যাবে। সেবাখাতসহ অন্যান্য খাত চাঙ্গা হয়ে উঠবে।
সরকারের ও ব্যক্তিখাতের সব প্রতিষ্ঠানের অপচয় কমাতে হবে। সব ধরনের ভ্রমণ, আপ্যায়ন এবং বিভিন্ন অ্যালাউন্স বাদ দিতে হবে। তাতে বেশ কিছু সাশ্রয় হবে। সরকারের আয় তেমনভাবে বাড়বে না, যদি না অর্থনীতি সচল হয়। সেক্ষেত্রে ধনীদের ওপর সম্পদকর আরোপ করার চিন্তা সরকার করতে পারে।
সঙ্গে নতুন বাজেটে কালো টাকা নিঃশর্তে বিনিয়োগ করার সুবিধা রাখতে হবে এবং সেটা না করলে পরবর্তীকালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখতে হবে। সরকারের উন্নয়ন কাজ কিছু কমাতে হবে; সেখানে বেশ কিছু টাকা বের হয়ে আসবে।
বাংলাদেশের মানুষের বড় শক্তি, তারা বিপদে একে অপরের কাছের স্বজন, বিশেষ করে বড় দুর্যোগে। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা তাদের সাহস জুগিয়েছে বারবার। নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, স্বাধীনতা যুদ্ধ তার বড় প্রমাণ।
তাছাড়া সরকার এবার সাধারণ মানুষের পাশে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা নিয়ে দাঁড়িয়েছে; যদিও তার যথাযথ বাস্তবায়ন সহজ নয়। অন্যায়, দুর্নীতি, জবাবদিহিতার অভাব এবং স্বজনপ্রীতি ও রক্ষক-ই-ভক্ষক মানসিকতা সরকারের এই প্রচেষ্টাকে প্রশ্ন বদ্ধ করবে, করেছে; তবু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সতর্ক উচ্চারণ দেশবাসীকে আশান্বিত করে।
দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চীনের চেয়ে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকবে। বিশ্ব অর্থনীতির চাকা যখন বন্ধ এবং লাখো মানুষের জীবিকা প্রশ্নের মুখে, ঠিক তখনই ৬৬টি দেশের অর্থনীতি নিয়ে এক গবেষণায় বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন আশার বাণী শুনিয়েছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্ট।
বাংলাদেশের মানুষের প্রচেষ্টা এবং অর্থনীতি ও বিশ্বে তার অবস্থান এমন নয় যে, এখানে কেউ না খেয়ে মারা যাবে।
- লেখক: কলাম লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল