বাংলাদেশের তুলা কেনার হুজ্জোত ও ফোর্স লেবারের অভিযোগ
বিশ্বখ্যাত পোশাকশিল্পের দুটি ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম আর নাইকি হঠাৎ করেই একটি অভিযোগ উত্থাপন করেছে যে চীন জিনজিয়ানের তুলা উৎপাদনে ফোর্স লেবার বা জোরপূর্বক শ্রম ব্যবহার করছে। চীনের এই প্রদেশে মূলত উইঘুর সম্প্রদায়ের বসবাস। এটি একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। চীনে এরকম পাঁচটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল রয়েছে। জিনজিয়ান ছাড়া বাকি আর চার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে তুলা উৎপাদন হয় না।
জিনজিয়ানে উইঘুর সম্প্রদায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের বেশিরভাগই মুসলমান। এছাড়াও, জিনজিয়ান চীনের উল্লেখযোগ্য একটি অর্থনৈতিক এলাকা। তুলার সঙ্গে এই প্রদেশটি সমৃদ্ধ তেল-গ্যাস আর কয়লার জন্য। চীন এখান থেকে উৎপাদিত তেল-গ্যাস ও কয়লা তার মূল ভূখণ্ডের অন্যান্য অংশের উন্নয়ন কাজে ব্যবহার করছে।
অনেক দিন ধরেই পশ্চিমা সরকারগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম জিনজিয়ানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর চীনাদের নানা ধরনের সহিংসতার অভিযোগ করে আসছে। যদিও এ অভিযোগের বস্তনিষ্ঠতা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করা যায়নি।
উইঘুর সম্প্রদায়ের এই প্রদেশের চতুর্দিকের দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানসহ আরও ৬টি দেশের সীমান্ত রয়েছে। এবং প্রতিবেশী এই দেশগুলোর সবই মুসলিম অধ্যুষিত। এবং এসব দেশের ভেতরে ধর্মীয় উগ্রবাদের উপস্থিতি রয়েছে। চীন রাষ্ট্রটি ব্যক্তির ধর্ম পালনে কোনো বাধার সৃষ্টি করে না, তবে ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে তাদের নিষেধাজ্ঞা আছে। ফলে পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রচার করে থাকে উইঘুর মুসলিমদের ধর্ম পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না।
চীনের এই অঞ্চলটি আদি সিল্ক রুটের অংশ, যে পথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল একসময়। এ পথ দিয়েই আরবরা চীনে বাণিজ্য করতে যেত। এই সময়ে, আধুনিককালে এখানে তেল গ্যাস এবং কয়লার সন্ধান পাওয়াতেও অঞ্চলটি পশ্চিমা সরকার সমূহের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
চীন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ তুলা উৎপাদনকারী দেশ। আর চীনের তুলার প্রায় ৮৭ শতাংশই উৎপাদিত হয় এই জিনজিয়াং প্রদেশে। উৎপাদিত এ তুলার পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টন। গত ২৫ বছর যাবত চীন অব্যাহতভাবে তার এই অঞ্চলে তুলা উৎপাদন বৃদ্ধি করে চলেছে। এই লেখকের বছর দুয়েক আগে জিনজিয়াং প্রদেশ ভ্রমণ করার সুযোগ ঘটেছিল। তখন তুলা সম্পর্কিত বেশ কিছু বিষয় লেখকের নজরে এসেছিল।
তুলাকে জিনজিয়ানের কৃষকরা একটি অর্থকরী ফসলে পরিণত করেছে, অর্থাৎ হিসাব করলে দেখা যায় এখানকার কৃষকদের হেক্টরপ্রতি আয় আছে দুই থেকে আড়াই হাজার মার্কিন ডলার। চীনা মুদ্রায় এই অঞ্চলের কৃষক, যারা তুলা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের দৈনিক আয় আছে ২০০ ইউয়ানের কাছাকাছি। তুলা উত্তোলন মৌসুমে এখানে তীব্র শ্রমিক সংকট হয় একথা সত্যি। যে কারণে কায়িক শ্রমের ঘাটতি দূর করতে ক্রমান্বয়ে মেশিন বা যন্ত্র শ্রমিককে প্রতিস্থাপিত করছে। ফলে এখানে ফোর্স লেবার ব্যবহার করার কোনো ঘটনার প্রমাণ নেই।
এর আগে ২০১২ সালে চীন প্রায় ৫ কোটি মানুষকে চরম দরিদ্র সীমা মুক্ত করার জন্য যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল, সেই লক্ষ্য তাদের অর্জিত হয়েছে ২০২০ সালেই। চীনই এ দাবিই করছে। এখন জিনজিয়ানের কর্মসংস্থানের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক আছে কিনা- সেটি আরেকটি ভেবে দেখার বিষয়। তবে জাতিসংঘেরও একই ধরনের দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচি ছিল। এতে পৃথিবীর জনগোষ্ঠীকে চরম দরিদ্রসীমার নিচে থেকে বের করে আনার জন্য ২০৩০ পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই কর্মসূচির বিপরীতে চীন ১০ বছর আগেই সাফল্য অর্জন করেছে। চীনের চরম দরিদ্র সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে: যাদের আয় ২.৩০ সেন্ট। আর জাতিসংঘ ঘোষিত চরম দরিদ্রসীমা ১.৯০ সেন্ট।
সব কিছু বিবেচনায় নাইকি এবং এইচঅ্যান্ডএম ব্র্যান্ড দুটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে মার্কিনীদের চীন বিরোধী বাণিজ্য যুদ্ধ এগিয়ে নেওয়ার জন্যই ফোর্স লেবারের মতো অভিযোগ উত্থাপন করেছে- এরকম সন্দেহ হতেই পারে। নাইকি এবং এইচঅ্যান্ডএম এর উত্থাপিত অভিযোগ আরও জোরদার হলে তাদের উৎপাদিত পণ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ফলে ব্র্যান্ড দুটিকে চীনকে বাদ দিয়ে নতুন উৎস খুঁজতে হবে। তাদের সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিকল্প উৎস থেকে সরবরাহ বা উৎপাদনেরও সমন্বয় করতে হবে।
তবে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে চীন যত দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে- তাতে বোঝা যায় যে বিষয়টাকে তারা যথেষ্ট গুরূত্বের সঙ্গেই নিয়েছে।
চীন- যুক্তরাষ্ট্র এই বাণিজ্য বিরোধের সময় আমাদের গার্মেন্টস শিল্পকেও তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে বিষয়টির দিকে। যদি অভিযোগকারীরা অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত করতে পারে- তাহলে বাংলাদেশের জন্য এটি ভালো খবর হবে বলা যায়। কারণ তুলা উৎপাদনের ক্ষেত্রে চীনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা আমাদের মতো দেশের জন্য সব সময়ই সুখবর।
আরেকটু ব্যাখ্যা করা যাক: গত ১০ বছর আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পাই, চীন যখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তুলা ক্রয় করে তখনই তুলার দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। কিন্তু, চীন যদি তুলার আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেতা হিসেবে আর হাজির না থাকে অর্থাৎ যদি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে তাহলে এই ঘটনা বাংলাদেশের অনুকূলে যাবে। একটা ঘটনা স্মরণ করা যাক, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ট্রাম্প যখন বিগত মার্কিন নির্বাচনের আগে একত্রিত হয়েছিলেন- তখন ট্রাম্প শি'কে অনুরোধ করেছিলেন চীন যেন আমেরিকা থেকে তুলা কেনা বাড়িয়ে দেয়। তখন আমরা দেখেছি কৌশলগত কারণে চীন মার্কিন অনুরোধে সাড়া দিয়ে প্রচুর পরিমাণে তুলা ক্রয় করেছিল।
আমাদের প্রায় ৭০ লক্ষ বেল তুলা আমদানি করতে হয়। গত দুই মাস যাবত আন্তর্জাতিক বাজারে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, তা হল : মূল্যের উত্থান ও পতন। এবং এই উত্থানপতনে আমাদের দেশের সুতাকলগুলো মারাত্মকভাবে ভুক্তভোগী হবে। আমরা দীর্ঘকাল ধরেই তুলা আমদানি করি। তুলা আমাদের পোশাক শিল্পের মেরুদন্ড। বিগত কয়েক বছরে আমদানিকারক হিসেবে আমরা বিশ্বের চতুর্থতম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে পাকিস্তান ও ভারত।
উপরে উল্লেখিত এই দু'দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সেই সুতার উৎপাদন বাড়ে। বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তান-ভারত, তুরস্ক, ভিয়েতনাম এমনকি উজবেকিস্তানেরও সুতা উৎপাদন বেড়েছে। উজবেকিস্তান এখন ৩০ লক্ষ বেলের উপরে তুলা নিজেরা সুতা উৎপাদনে ব্যবহার করে।
কিন্তু, আমাদের তুলা আমদানি করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের হেজিং(এক ধরনের ইন্সুরেন্স বলা যেতে পারে) ব্যবস্থা না থাকার ফলে আমাদের দেশের সুতাকলগুলো সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত কয়েকদিনের এই দরের উত্থানপতনেও আমাদের মিলগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে।
আন্তর্জাতিক তুলার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে আমাদের দেশের সুতা উৎপাদনকারী মিলগুলোর তুলা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি করতে হয়, এই চুক্তি অনুসারেই তুলার দাম এবং সরবরাহের সময় নির্ধারিত হয়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণপত্র খুলতে হয়, কিন্তু, তুলার বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে অনেক সময়ই তুলার দাম পড়ে যাওয়াতে বাংলাদেশের মিলগেুলো চুক্তির শর্ত অনুসারে ঋণপত্র উন্মুক্ত করতে পারেনা। ফলে, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো তখন বাংলাদেশের মিলগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করে। এ ধরনের ঘটনায় আমাদের দেশের বহু মিল আন্তর্জাতিক তুলা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কালো তালিকাভুক্ত হয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তুলা কেনার ক্ষমতা হারায়। যতদিন মিলগুলো ক্ষতিপূরণ পরিশোধ না করে ততদিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকে।
২০১১-১২ সালে যখন তুলার বাজারমূল্য প্রতি পাউন্ড দুই ডলারের বেশি হয়েছিল, তারপর দ্রুতই দর পতন ঘটে আগের দাম ৮০/৯০ সেন্ট থেকে, তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের মিলগুলো। সময়মতো ঋণপত্র খুলতে না পারায়; আন্তর্জাতিক তুলা সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর তরফ থেকে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরনের মুখে পড়ে বাংলাদেশের মিলগুলো। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধের মাধ্যমে কালো তালিকা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করেছিল বাংলাদেশের সুতার মিলগুলো।
যদিও, বিশ্বব্যাপী তুলা রপ্তানির কাজে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম, তবে অস্তিত্বমান কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগের মালিকানা পশ্চিমা দেশগুলো। এরা কয়েক শত বছর যাবত এই কর্তৃত্ব অর্জন করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোর উৎপাদিত তুলা ফ্রান্স, ব্রিটিশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সিঙ্গাপুরের কোম্পানিসমূহ বাজারজাত করে। এরকম বড় তুলা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০টি। এরাই দুনিয়াজুড়ে তুলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। আন্তর্জাতিক বাজারের তুলা ক্রয়-বিক্রয় নিয়ন্তা এই কোম্পানিগুলোই।
চীন বড় পৃথিবীর এক নাম্বার তুলা আমদানিকারক দেশ। ফলে বড় বড় তুলা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চীনের বন্দরগুলোয় তুলার নিজস্ব গোডাউন গড়ে তুলেছে। যেখান থেকে তারা চীনে যেমন তুলা বিক্রি করে- তেমনি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বিক্রি করে। নিজেদের বন্দরেই বিশাল মজুদ থাকাতে চীনা কোম্পানিগুলোর তুলার জন্য ঋণপত্র খুলতে হয় না। আমাদের দেশের সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তুলা আমদানি করার জন্য প্রায় তিনমাস আগেই ঋণপত্র দিতে হয়। ফলে এক বিশাল আমদানি ব্যয় ও চলতি মূলধনের প্রয়োজন হয়। বিপরীতে চীনের অভ্যন্তরে তুলা সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকায় চীনের সুতা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে এই বিশাল খরচ বহন করতে হয় না। তারা স্বল্প পুঁজিতেই তুলা কিনতে পারে এবং গুণগত মান নিয়েও কোনো সংকট সৃষ্টি হয় না। চীনের তুলনায় বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোকে দীর্ঘ সময় এবং বড় ধরনের পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে দেশে, কিন্তু বিষয়টির সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেই।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক