বাংলাদেশ: ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠা ফিনিক্স
চার দশকের ব্যবধানে দুজন অর্থনীতিবিদের দুটি বিপরীত মন্তব্য বাংলাদেশের উন্নতির কাহিনি বলে দেয়।
১৯৭৩ সালে ক্যামব্রিজের অর্থনীতিবিদ অস্টিন রবিনসন লিখেছিলেন, 'এই মুহূর্তে বাংলাদেশ হলো মালথুসিয়ান স্থবিরতার একটি টেক্স-বুক উদাহরণ।... বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখে চরম দারিদ্র্য থেকে এর পরিত্রাণের কোনো রাস্তা দেখছি না আমি।'
বছর দুয়েক আগে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য সহকারে মালথুসিয়ান স্থবিরতা থেকে বাংলাদেশের নিস্তার পাওয়ার সাফল্যের বেশ উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন। তিনি লিখেছেন, "দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশ বরং একটি উদীয়মান 'টাইগার' অর্থনীতি হয়ে উঠেছে।"
রবিনসনের মন্তব্য দেশটির একটি সর্বনাশা অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছিল। অন্যদিকে, তার সেইসব বেদনাদায়ক মন্তব্যের প্রতি একটি উপযুক্ত জবাব হয়ে ওঠে কৌশিক বসুর মন্তব্য।
তবু, পণ্ডিতরা যেমনটা বলে থাকেন- প্রতিটি জাতির ভবিষ্যৎ নিজের ইতিহাসের সঙ্গে সেটির অবিচ্ছিন্ন সংযোগ গড়ে তোলার মতো একগুচ্ছ পছন্দের ওপর গড়ে ওঠে; সেই কথার সূত্র ধরে বাংলাদেশের অতীতের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।
অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যতের আশঙ্কা থেকে জাগরণ
৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে হারানোর মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়ার এক বছর পর ঢাকায় বিদেশি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের এক অসাধারণ সম্মেলনের আয়োজন করতে পারা ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি দারুণ ঘটনা।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে গবেষণা করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, নরওয়ে, জাপান ও ভারতের মতো সমাজতান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও মিশ্র অর্থনীতির দেশগুলোর প্রায় দুই ডজন অর্থনীতিবিদ যোগ দিয়েছিলেন ওই সম্মেলনে।
আয়োজকদের পক্ষে অংশ নিয়েছিলেন নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহান-সহ এক ডজনেরও বেশি বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ। প্ল্যানিং কমিশন ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিকসের (বর্তমানে, বাডস) পরিকল্পনায় ওই সম্মেলনে গবেষণাপত্র লিখেছিলেন তারা।
সেখানে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের একটি সমন্বয় ঘটেছিল, যেন নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি কৌশল নির্ধারণ করতে পারে বাংলাদেশ।
দুর্ভাগ্যক্রমে, এমনতর ব্যয়বহুল সম্মেলন আয়োজন করার মতো যথেষ্ট অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছিল না বাংলাদেশের। বলতে গেলে একেবারেই শূন্য হাতে মাত্র এক বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল সরকার। বিদেশি সাহায্যের ওপর বড়মাত্রায় নির্ভর করতে হয়েছে তাকে। এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার তার সেই কুখ্যাত মন্তব্য করেছিলেন, 'বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি।' নিউইয়র্কভিত্তিক 'ফোর্ড ফাউন্ডেশন' ও লন্ডনভিত্তিক থিংক-ট্যাংক 'ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিক অ্যাসোসিয়েশনে'র বিশেষ সহায়তার সম্মেলনটি আয়োজন করা সম্ভব হয়েছিল।
সম্মেলন শেষে চরম দারিদ্র্য নিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ শীতল পূর্বাভাস মাথায় নিয়ে ঢাকা ছাড়েন ওই অর্থনীতিবিদরা।
তৎকালীন বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওই বিদেশি অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল?
সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেওয়া ক্যামব্রিজের অর্থনীতিবিদ অস্টিন রবিনসন এই সদ্য জন্মানো দেশের একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন রূপ তুলে ধরেছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ওপর এক গবেষণাপত্রে তিনি লিখেন, যুদ্ধের ক্ষত থেকে মাত্রই সেরে ওঠতে থাকা এই নতুন দেশের সরকার প্রবল খাদ্য ঘাটতি, বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অপ্রতুল আর্থিক রিজার্ভ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ভেঙে পড়া-সহ অগুণতি দৈনন্দিন সমস্যা ও সংকটের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে।
তাদের দৃষ্টিতে, সদ্য জন্ম নেওয়া এ দেশের অবয়ব এতটাই করুণ ছিল, দেশটির অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন কিছু পণ্ডিত ও অর্থনীতিবিদ: 'বাংলাদেশ টিকবে তো?'
'বিদেশি সাহায্যের ওপর প্রবলভাবে নির্ভর করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের একটি অধীনস্থ অংশ হয়েই রয়ে যাবে এ দেশ- এমন ভয় কাজ করেছে অনেক পণ্ডিত ও বিশ্লেষকের মনে। কেউ কেউ তো জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির হারে খাদ্য লভ্যতার প্রশ্নে দেশটিতে একটি মালথুসিয়ান দুঃস্বপ্ন নেমে আসারও অনুমান করেছেন,' লিখেন রবিনসন।
ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনটিতে যোগ দেওয়া মার্কিন অর্থনীতিবিদন হলিস চেনারি বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্কে একটি শীতল পূর্বাভাস প্রকাশ করে জানান, মাথাপিছু আয় ৭০ ডলার থেকে ৯০০ ডলারে উন্নীত করতে দেশটির ১২৫ বছর লেগে যাবে।
বাংলাদেশের উত্থান
দিনে দিনে বয়ে গেছে দিন। সে সময়ের সেই সদ্য জন্মানো দেশ এখন পা রেখেছে পঞ্চাশের ঘরে, আর বিশ্বকে শোনাচ্ছে এক ভিন্ন গল্প: বহু ক্ষেত্রেই সাফল্যে ভরা গল্প। ৪০ বছরের মধ্যেই মাথাপিছু গড় আয় ১০০০ ডলারে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে এ দেশের মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলারেরও বেশি। তার মানে, অর্থনীতিবিদ চেনারির অনুমান মিথ্যে হয়ে গেছে।
বাংলাদেশকে এখন অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি মডেল হিসেবে গণ্য করা হয়।
উদাহরণ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মন্তব্য ধরা যাক। 'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় ও অভাবনীয় সাফল্যের কাহিনি শোনানো দেশগুলোর একটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ,' ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামে লিখেন ওই অর্থনীতিবিদ। "অগ্রগতিশীল সামাজিক নীতিমালা ও খানিকটা ইতিহাসগত সৌভাগ্যের ফল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশ বরং একটি ঊর্ধ্বচারী 'টাইগার' অর্থনীতি হয়ে উঠেছে।"
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের প্রশংসা আসলে নতুন কিছু নয়।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করে যাচ্ছেন।
২০০৫ সালে তিনি পল্লী উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের সাফল্যের উচ্চকিত প্রশংসা করেন এবং এইসব খাতে সাফল্য পেতে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে অনুসরণের আহ্বান জানান ভারত সরকারের প্রতি।
'বাংলাদেশের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে,' এইসব খাতে বাংলাদেশের লক্ষণীয় অর্জন ঘিরে কলকাতা প্রেস ক্লাবে এক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যমগুলোও বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
২০০০ সালের পর থেকে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধার্তের হার অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় ২০১৫ সালে একদার কথিত 'খাদ্যের তলাবিহীন ঝুড়ি' অবস্থা বাংলাদেশের ওপর আলোকপাত করে বিশ্ব ক্ষুধার ওপর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
একই বছর 'বাংলাদেশ বিকেম অ্যা মডেল ফর রিডিউসিং হাঙ্গার' শীর্ষক প্রতিবেদনে দ্য ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর লিখেছে, চার দশক আগে, সদ্য জন্ম নেওয়া ও ভয়াবহ দরিদ্র দক্ষিণ এশিয়ান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নিজের দারিদ্র্য ও বন্যার কারণে তীব্র হয়ে ওঠা স্থায়ী ক্ষুধার সবচেয়ে চরম অবস্থার দেখা ইতোমধ্যে পেয়ে গিয়েছিল চুয়ান্তরের দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে।
বানের জলে কৃষক ও কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আমদানিকৃত খাদ্য সরবরাহ হয় বিঘ্নিত, আর এসবের ওপর নির্ভর করা দেশটিতে আনুমানিক ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। ১৯৭১ সালে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'-এর মাধ্যমে যে দেশের পক্ষে টাকা ওঠানো ও সচেতনা বাড়ানোতে ভূমিকা রেখেছিলেন বিটলস ব্যান্ডের প্রাক্তন সদস্য জর্জ হ্যারিসন, ক্ষুধা ও অপুষ্টির সঙ্গে সেই দেশের দীর্ঘ সম্পর্কের প্রতিবেদন প্রকাশ পেতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলোতে।
"এক সময়ের খাদ্যের 'তলাহীন' ঝুড়ি এখন একটি খাদ্যের ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে, এবং বাকি দুনিয়ার কাছে পরিণত হয়েছে ক্ষুধা হ্রাসের একটি মডেলে,' পাঁচ বছর আগে লিখেছে দ্য ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর।
১৯৭৩ সালের সম্মেলনে বাংলাদেশ মালথুসিয়ান স্থবিরতার দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হওয়ার যে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদরা, সেটি মিথ্যে হয়ে গেছে।
১৯৭৩ সালে অর্থনীতিবিদরা, যেমন ধরুন অস্টিন রবিনসন তার গবেষণায় লিখেছিলেন, নাকাল করা দারিদ্র্য থেকে পালিয়ে ক্রমবর্ধমান উন্নতির দেশে বাংলাদেশ পরিণত হতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন; কেননা, বাংলাদেশ মালথুসিয়ান স্থবিরতার একটি টেক্সট-বুক উদাহরণ।
কৃষকরাই এই সাফল্যের 'আনসাং হিরো'; কেননা, তারাই বাংলাদেশকে একটি খাদ্যের ঝুড়িতে পরিণত করেছেন এবং অন্যান্য দেশের ক্ষুধা হ্রাসে একটি মডেল হিসেবে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন।
বাংলাদেশের উন্নতির কাহিনিটি যেন সেই পুরাণের সমার্থক হয়ে উঠেছে: ছাই থেকে ফিনিক্সের উত্থান।
আমাদের পূর্বপুরুষরা, দুই শতাধিক বছর আগে বেশ ভালোই ছিলেন। এমন দাবি স্রেফ আমাদেরই নয়, বরং অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত পর্যটকদের ট্রাভেলগেও এসব ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
কিন্তু ৫০ বছর আগে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হলো, তখন এটি পৃথিবীর সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি। পাকিস্তানের দিনগুলো বাঙালিদের জন্য ছিল তিক্ত অভিজ্ঞতা। প্রায় দুই দশক ধরে, অবিভক্ত পাকিস্তানের আমলে বাংলাদেশ, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল অর্থনৈতিক স্থবিরতায় বন্দি; পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বৈষম্য ছিল মারাত্মক; কেননা, পুঁজিগুলো কম-উন্নত পূর্বের কাছ থেকে বেশি-উন্নত পশ্চিম পাকিস্তানেই নিয়ে যাওয়া হতো।
এক অসহনীয় যাত্রার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে এ দেশের জনগণকে। রক্ত ও আগুনের ভেতর দিয়ে জন্ম নেওয়া এই দেশের পুনর্গঠনের জন্য সম্পদ ছিল অতি সামান্য। কোনো খনিজ সম্পদ না থাকা দেশটির মাটি, পানি ও মানুষের হাতই ছিল সম্বল। আরেকটি বড় শক্তি ছিল এর জনগণের অদম্য স্পৃহা।
মানুষ নিজেই নিজের নিয়তির মালিক। নিজেদের জীবন ও জীবিকার উন্নতি ঘটাতে নিরলস খেটে যায় তারা। বছরের পর বছর ধরে, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা, কোনো অপশাসনই মানুষকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। এই অদম্য স্পৃহা বাংলাদেশকে একটি অলৌকিকতায় পরিণত করেছে। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু যেমনটা বলেছেন, "দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর একটি হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশ বরং একটি ঊর্ধ্বচারী 'টাইগার' অর্থনীতি হয়ে উঠেছে।"
২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ১৯৭৩ সালে অতি অবাস্তব কল্পনায়ও ভাবা যায়নি। এই রেকর্ড প্রবৃদ্ধি ১৯৭৩ সালের সম্মেলনে যুগোস্লাভিয়ার ইনস্টিটিউট অব ইকোনোমিক সায়েন্সের অর্থনীতিবিদ ব্রাঙ্কো হোভার্টের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মনে করিয়ে দেয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি-সহ আরও কয়েকজন অর্থনীতিবিদ আশা করেছিলেন, প্রতি বছর ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বাংলাদেশ। তার সেই পূর্বাভাসকে অবশ্য ক্যামব্রিজের অর্থনীতিবিদ রবিনসন-সহ আরও কেউ কেউ অবাস্তব বলেই গণ্য করেছিলেন। তবে তাদের সেই অনুমান মিথ্যে হয়ে গেছে। সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের মানুষের সম্ভাবনার কথা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন ব্রাঙ্কো।
এই রেকর্ড প্রবৃদ্ধি আসলে অর্থনৈতিক সাফল্যের একটি ধারাবাহিকতা। গত এক দশকে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটেছে বাংলাদেশের। প্রবৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতার শক্তিই বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত-প্রবৃদ্ধিশীল অর্থনীতির পাঁচটি দেশের একটিতে পরিণত করেছে।
এই বেগবান প্রবৃদ্ধি আমাদের দেশের মর্যাদাকে ২০১৫ সালে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ ২০১৮ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে প্রথমবারের মতো উঠে আসার তিনটি যোগ্যতামূলক শর্তের প্রতিটি পূরণের সক্ষমতা এনে দিয়েছে এবং ২০২৪ সালের মধ্যে পরের ধাপে উন্নীত হওয়ার সঠিক পথেই রয়েছে দেশ। ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্য উপার্জনের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছি আমরা।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো সব আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবিদ আমাদের এই প্রবৃদ্ধির গল্পকে দারুণভাবে নিয়েছেন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে তাদের মনে একটা ফুলেল ছবি আঁকা হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পথচলা অবশ্য কখনোই মসৃণ ছিল না। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ- বহু বাধা পেরিয়ে আসতে হয়েছে দেশটিকে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছরে রাষ্ট্র ক্ষমতা ও শাসনভার সামরিক স্বৈরশাসকদের দখলে চলে গেলে লক্ষ্যচ্যূত হয়েছিল এ দেশ।
১৯৯০ সালের শেষদিকে সামরিক একনায়ক হুসেইন মোহম্মদ এরশাদের শাসনের পতন ঘটার পর দেশটি নতুন যাত্রা শুরু করে। তার পর থেকে ধীরে ধীরে একটি নতুন চেহারা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
তৈরি পোশাক রপ্তানি, প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে পাওয়া রেমিট্যান্স, আমাদের কৃষকদের নিরলস প্রচেষ্টায় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি- এইসব ঘটনা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরাণ্বিত করেছে, যা কি না গত এক দশক ধরে রয়েছে অবিচল।
বহু সাফল্য ইতোমধ্যেই অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবু বৈষম্য, দুঃশাসন, গণতান্ত্রিক ঘাটতি, জোরাল প্রাতিষ্ঠানিকতার অনুপস্থিতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে গুণগত মানের অভাব, বায়ুদূষণ বৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক অবক্ষয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধির মতো ঘটনার যন্ত্রণাদায়ক উত্থান আমাদের প্রবৃদ্ধির গুণ নিশ্চিন্তের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আর এ সবগুলো বিষয়ই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী।
তবু, এইসব বিপত্তির বিপরীতের আশাও জাগ্রত। আমাদের দেশের মানুষ অতীতে যেমনটা করেছেন, এবং বর্তমানে এই করোনাভাইরাস মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেভাবে লড়ছেন, তাদের সেই প্রাণোচ্ছলতাই আশা দেখায়। জোরাল স্বাস্থ্যসেবা নিয়েও করোনাভাইরাসে নিরন্তর ভুগতে থাকা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় স্বাস্থ্যসেবা খাতের হতদরিদ্র অবস্থা সত্ত্বেও আমাদের দেশে এ ভাইরাসে মৃতের হার কম।
তিন মাসের শাটডাউন শেষে আমাদের অর্থনীতি আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বেশিরভাগ অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার বিপরীত হিসেবে আমাদের অর্থনীতিতে গত অর্থবছরে ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) জানিয়েছে, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারিকালে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি বিবেচনায় প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি জোরালভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমাদের কিছু অর্থনীতিবিদ আশা করছেন, অন্য অনেক দেশের চেয়ে দ্রুত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করবে বাংলাদেশ।
বিধ্বংসী ২০২০ সালের শেষ প্রান্তে এসে আমরা আরেকটি মাইলফলক অর্জন করেছি: নিজেদের টাকায়, প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার খরচে দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো- ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসানো হয়ে গেছে বিজয় দিবসের এক সপ্তাহ আগে, ১০ ডিসেম্বর। সেতুর মূল অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন চেহারা নিয়ে জন্ম নেওয়া দেশ- বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার এক দারুণ উদাহরণ হয়ে উঠবে।
আগামী বছর আসন্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তির ঠিক আগে ধরা দিলো এত বড় সাফল্য। এটিও বাংলাদেশের অদম্য স্পৃহারই পুনরাবৃত্তি। বড় বাধাগুলো কমিয়ে আনতে পারলে আরও বেশি উজ্জ্বল রূপে বিশ্ব ময়দানে বাংলাদেশ ঝলঝল করতে পারবে, এটি তারই আরেকটি প্রমাণ।
আইনের শাসন ও অধিকারের প্রশ্নে বৈশ্বিক সূচকে নিজেদের দেশের অবস্থান তলানিতে দেখতে বাংলাদেশিদের খারাপ লাগে। তাদের আশা, এইসব সূচকে অন্যান্য জাতির মতো শীর্ষেই অবস্থান করবে বাংলাদেশ।
আধুনিক ইতিহাসে পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত সম্প্রদায়- ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে দুনিয়ার বুকে মানবতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টিকারী একটি দেশের নিশ্চয়ই আরও ভালো কিছু প্রাপ্য।
- অনুবাদ: রুদ্র আরিফ
- মূল লেখা: Bangladesh: The rise of a Phoenix from the ashes