যৌন হয়রানির হাত থেকে কি নারী পুলিশও নিরাপদ নন?
আসাদগেট মোড়ে একজন নারী সার্জেন্টকে দেখলাম একটি গাড়িকে অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য ফাইন করলেন। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম দৃশ্যটা, দায়িত্বপালনকালে নারী সার্জেন্টটিকে এত স্মার্ট লাগছিল যে চোখ জুড়িয়ে গেল।
পুলিশ, সেনাবাহিনী বা পাইলটের পোশাকে যখন কোনো নারীকে দেখি, তখন আমার অন্যরকম একটা আনন্দ হয়, গর্ব হয়। সম্ভবত আমি একজন নারী বলেই হয়তো এমনটা হয়। মনে হয় এই নারীরা শক্তির আধার।
শুধু এই পেশাকগুলোর কথাই-বা বলি কেন, যখন কোনো নারীকে যখন আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক খাতে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে মেরুদন্ড সোজা করে কাজ করে যেতে দেখি, তখন সেই ছবিও আমাকে আনন্দ দেয়।
মাঠে কাজ করছেন নারী কৃষক, সারারাত জেগে রাস্তা মেরামতের কাজ করছেন নারীরা, পিঠে বাচ্চা নিয়ে ইট, কাঠ, পাথর, বালু সব মাথায় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন নারী শ্রমিক। এসব আমি অবাক হয়ে দেখি। ভাবি কে বলে নারী অবলা?
আবার খুব মুষড়ে পড়ি, যখন দেখি কর্মক্ষেত্রে নারী যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি খবর দেখে মনটা আরও বেশি খারাপ হলো। সেখানে বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নিজ বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা কোনো কোনো নারী পুলিশ সদস্য যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন ।
অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দিলে বদলি-বিভাগীয় মামলার হুমকি, অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ, এমনকি পোশাক নিয়েও বাজে মন্তব্য করেন কতিপয় ঊর্ধ্বতন ও একই র্যাংকের পুরুষ পুলিশ সহকর্মীরা।
বাহিনীটির সশস্ত্র ও নিরস্ত্র দুই বিভাগেরই কনস্টেবল, নায়েক, এএসআই, এসআই পর্যায়ের নারী পুলিশ সদস্যরা এমন হয়রানির শিকার হন বলে সম্প্রতি এক জরিপে উঠে এসেছে। পুলিশে কর্মরত নারী যখন যৌন হয়রানির শিকার হন, তখন বুঝতে হবে বাকি কর্মজীবী নারীদের অবস্থা কতটা অসহায়।
এই জরিপটি করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। রেঞ্জ, মেট্রোপলিটন, পার্বত্য অঞ্চল ও বিশেষায়িত ইউনিটের কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদবির ৪৪১ জন পুলিশ সদস্য 'বাংলাদেশ পুলিশের সংস্কার ও উন্নয়নে মাঠ পর্যায়ের মতামত' শিরোনামে এই জরিপে অংশ নেন।
উত্তরদাতাদের মধ্যে ১৩৮ জন অর্থাৎ প্রায় ৪০ শতাংশ জানিয়েছেন, নারী সদস্যরা যৌন হয়রানির শিকার হন। (সূত্র: আজকের পত্রিকা)
খুব সম্প্রতি এক নারী পুলিশ ইন্সপেক্টর একজন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের বিরুদ্ধে ছয় বার ধর্ষণের অভিযোগ এনে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেছেন। সুদানে শান্তি মিশনে চাকুরিরত অবস্থায় এই ঘটনা ঘটে ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে।
রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণের বিরুদ্ধে গত মার্চ মাসে যৌন হয়রানির এই অভিযোগ এনেছিলেন পুলিশের একজন নারী সদস্য।
তিনি বলেছেন, "আমার মতো এমন অনেক নারী আছেন, যারা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। একটা সময় বাংলাদেশ পুলিশের নারী সদস্য হিসেবে নিজেকে নিয়ে অনেক গর্ব করতাম। কিন্তু পদে পদে এত হয়রানির শিকার হয়েছি যে, এখন আর গর্ব করতে পারি না। বাহিনীতে গুটিকয়েক এমন খারাপ সদস্যের উপযুক্ত শাস্তি দিতে না পারলে, এই যৌন হয়রানি সংক্রমিত হতেই থাকবে।"
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসআই র্যাংকের আরেকজন নারী সদস্য গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দুই বছর আগে এক রাতে তিনি ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় এক পুরুষ সহকর্মী তাকে খারাপ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে বিষয়টি গোপনেই সমাধান করা হয়।
পুলিশ বাহিনীর মতো পেশাদার একটি বাহিনীর জন্য বিষয়টি নিঃসন্দেহে অনভিপ্রেত। কারণ তারা মানুষের হেফাজত করেন। তাদের ভিতরেই যদি এরকম অপরাধমূলক কার্যক্রম ঘটতে থাকে, তাহলে তা নিঃসন্দেহে লজ্জাজনক।
তবে, একথাও ঠিক যে দেশে সর্বস্তরেই ধর্ষণের হার বাড়ছে আশঙ্কাজনকহারে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৮১৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। একই সময়ে ৫০৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
এদের মধ্যে ৪৯ জনের বয়স ছয় বছরের নিচে, ৯৩ জনের বয়স সাত থেকে ১২ বছরের মধ্যে এবং ১৩২ জনের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
এরকম একটি সামাজিক পরিস্থিতিতে নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়, কর্মক্ষেত্রে-তো নয়ই। যদিও আমরা কর্মক্ষেত্র বললে পোশাকশিল্পকেই বুঝি। কিন্তু পোশাকশিল্প ছাড়াও আরও অনেক ধরনের কর্মক্ষেত্র রয়েছে।
চা-শিল্প, চামড়াশিল্প, ব্যাংক, এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আদালত, গণমাধ্যম, চিংড়িঘের, বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা কাজ করছেন। সবখানেই নারী সহিংসতা ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
নারী কর্মী এবং শ্রমিকরা এ বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান। কোন কোন আচরণ যৌন হয়রানি, সেটাও অনেকে বুঝতে পারেন না। আবার অনেকে জানার পরও বলতে চান না। কারণ, যদি এজন্য তার চাকরি চলে যায়? কেউ কেউ মনে করেন, পুরুষরা এমন আচরণ করবে এবং এটাই স্বাভাবিক।
কিছু কারখানায় এবং অফিসে যৌন হয়রানির জন্য অভিযোগ বাক্স আছে ঠিকই। কিন্তু কীভাবে অভিযোগ করতে হবে, কার কাছে করতে হবে, কবে অভিযোগের শুনানি হবে, দোষীর কী শাস্তি হবে এসব বিষয়ে তেমন কোন তথ্য নেই।
কে, কোথায়, কীভাবে, যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেটা বলা না গেলেও, এটা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায় নারী কর্মস্থলে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
২০২০ সালে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্সের সহায়তায় জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের করা একটি জরিপে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী ১৩৫ জন নারীর শতভাগই নিজ কর্মস্থলে কোনও না কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানান।
উত্তরদাতাদের একটি বড় অংশ অর্থাৎ ৮৯ জন জানেনই না যে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বিষয়ক নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বা এ সম্পর্কে হাইকোর্টের একটি গাইডলাইন আছে।
২০০৯ সালে সুপ্রীম কোর্ট কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১১টি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিল। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল।
কীভাবে অভিযোগ দিতে হবে এবং কীভাবে সেগুলোর নিষ্পত্তি হবে, সে ব্যাপারেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেখানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে পৃথক আইন করার কথা বলা হলেও এখন অব্দি কোনো আইন হয়নি।
বাংলাদেশে কর্ম ও শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। এদেশের মোট শ্রমশক্তির এক কোটি ৮৭ লাখ নারী। এই অসংখ্য নারীর জন্য আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলো কতটুকু নারীবান্ধব? কর্মক্ষেত্রে যৌন সহিংসতা ঠেকানোর এবং নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো কি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে?
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে প্রায় ৩৬ শতাংশ নারী অনাকাঙ্খাকিত যৌন আচরণ, যৌন প্রস্তাব বা অন্যান্য ধরনের হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। এর মধ্যে ধর্ষণ, মুঠোফোনে অশালীন বার্তা পাঠানো, ফোনে অশ্লীল কথা বলা, গায়ে হাত দিয়ে কথা বলা, বাজে অঙ্গভঙ্গি, বাজে কথা বলে বকাঝকা করা, খারাপভাবে দেখা সবই রয়েছে।
ফিরে আসি ২০১৬ সালে করা পুলিশ সংক্রান্ত আরেকটি জরিপে। আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভের (সিএইচআরআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে পুলিশে কর্মরত নারী কনস্টেবলদের ১০ ভাগের বেশি সদস্য যৌন হয়রানির শিকার হন।
উপপরিদর্শক ও সহকারী উপপরিদর্শক পদের নারী কর্মকর্তাদের শতকরা তিনভাগ এ ধরনের ঘটনার শিকার হন। এছাড়া ক্যাডার পর্যায়ের নারী পুলিশ সদস্যরাও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বাইরে নন। জরিপকে মনগড়া ও বিভ্রান্তিকর দাবি করে পুলিশ তখন এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। কিন্তু ঘটনাতো থেমে থাকেনি।
বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি ও উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আমেনা বেগম কর্মক্ষেত্রে নারী পুলিশ সদস্যদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার ঘটনাকে স্বীকার করেছেন।
তবে অনেকেই এসব বিষয়ে মুখ খুলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এই সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করছে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড (ডিএনপিএস) বিভাগ। তদন্ত শেষে অভিযোগের সত্যতা মিললে দোষীকে শাস্তি দেওয়া হয়।
কর্মক্ষেত্রে নারী যৌন হয়রানির শিকার হলে সবসময়ই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান 'সুনাম' রক্ষায় ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। ভুক্তভোগী নারীকেও নানান ধরনের জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এছাড়া, সমাজের ভিকটিম ব্লেইমিংতো আছেই। অভিযোগ প্রমাণের কাজটিও বেশ জটিল।
আজকের এই আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে আমরা বলতে চাই নারীর জন্য এই দেশ, কর্মক্ষেত্র. শিক্ষাঙ্গন, পথঘাট, যানবাহন এবং পরিবার হোক যৌন নিপীড়নমুক্ত। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার সংবেদনশীল ব্যবস্থাপনা ও নীতিমালা থাকা আবশ্যক। যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে আইন না হওয়া পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা দরকার।
নীতিমালা অনুযায়ী অভিযোগ দায়ের, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘটনার তদন্ত ইত্যাদি বিষয়ে স্টাফদের জানাতে হবে এবং অফিস ম্যানেজমেন্টকে ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হতে হবে।
বিশেষ করে কোনো নারী যদি যৌন হয়রানির শিকার হন এবং সে বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেন, তাহলে অবশ্যই প্রতিষ্ঠানকে তা আমলে নিতে হবে। সময় এসেছে নারী কর্মী ও শ্রমিকদের প্রতিবাদী হয়ে সংঘবদ্ধ হওয়ার।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন