আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কি ভোক্তা অধিকার আইনের আওতায় আনা উচিত?
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা নিয়ে অস্থির অবস্থা চলছে বহু কাল যাবৎ। সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে প্রথম জানা গেল কোন বেসরকারি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক তাদের পরিচালকদের কাউকে নিয়মবহির্ভূত ভাবে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বহু লক্ষ টাকা বিদেশে পাচার করার সুযোগ করে দিয়েছে, তার পাচার করা টাকার পরিমাণ কত সঠিকভাবে জানা যায়নি। বিষয়টি মানি লন্ডারিংয়ের পর্যায়ে পড়ে কিনা তাও আমরা জানতে পারিনি। তবে ব্যাংকের বিরুদ্ধে নাকি শাস্তি মূলক ব্যবস্থা হিসেবে নগদ অর্থ জরিমানা করা হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে এরপর প্রকাশ পেয়েছে আরেকটি সংবাদ: ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা তাদের বাৎসরিক লিমিট ভঙ্গ করে অতিরিক্ত টাকা খরচ করছে এবং ব্যাংকগুলো তাতে সহায়তা প্রদান করছে। এই খবর ফাঁস হওয়ার পর ব্যাংকগুলোকে পাঁচ কর্ম দিবস সময় দেওয়া হয়েছে কারণ দর্শানোর জন্য।
প্রশ্ন হলো, এই অবস্থা কি নতুন ? আজই প্রথম ঘটল? না অতীতেও ঘটছিল? আমরা যতটুকু জানি? দীর্ঘকাল ধরে এটা চলে আসছে।
ব্যাংক সবসময়ই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে তার গ্রাহকদেরকে প্রলুব্ধ করেছে নানান ভাবে। এর কারণ হচ্ছে ক্রেডিট কার্ডের বাৎসরিক ফি, দ্বিতীয় হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার ফলে ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট আয়। ক্রেডিট কার্ডের জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমত মটর ইঞ্জিনের তেল ক্রয়ের ও বিদেশ ভ্রমণের জন্য বিমানের টিকিট সংগ্রহ করার সুবিধার্থে এর ব্যবহার শুরু হয়।
ব্যাংক কখনোই এই ক্রেডিট কার্ডের লিমিটটি অনুসরণ করেনি। আজকে যখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দিয়েছে তখন নিয়ন্ত্রণকারী বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিটি ক্ষেত্রেই তদন্ত করছে এবং নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের এই ১২০০০ ডলার লিমিটের ব্যাপারে সবসময় প্রশ্ন ছিল! কারণ ১২০০০ ডলার এমন কিছু টাকা নয়। মানুষ তার ব্যবসা কিংবা অন্য যে কোনো প্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণ করলে এই টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার কথা।
তাহলে প্রশ্ন হলো ক্রেডিট কার্ড না হলে তার প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা কোন পদ্ধতিতে সে সংগ্রহ করবে? এই প্রয়োজন মেটানোর একমাত্র খোলা রাস্তা হচ্ছে হুন্ডি। বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘকাল এ বিষয়টিকে কখনো মাথায় নেয়নি । ফলে ব্যাংকগুলো তার গ্রাহকের যত বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন পড়েছে তারা ব্যাংকের সেই লিমিট ভঙ্গ করেই খরচ করতে দিয়েছে। তাহলে এর দায়ভার কার?
আবার এই বৈদেশিক মুদ্রা খরচকারীদের বাৎসরিক আয়কর হিসাবে তাদের এই বৈদেশিক মুদ্রা খরচের হিসাব প্রদান করা হয় কিনা তাও আমাদের জানা নেই। দেশের প্রচলিত আয়কর আইনেও এ বিষয়ে কোন কিছু বলা নাই। দ্বিতীয়ত হচ্ছে বাংলাদেশের কি সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী বিদেশে পড়াশোনা করে তার সঠিক কোন তথ্য কারো কাছেই নেই। এই ছাত্রছাত্রীদের জন্য আমাদের রাষ্ট্র থেকে তাদের বেতন এবং খুব সামান্য পরিমাণ দৈনন্দিন জীবনের খরচ মেটানোর একটি কোটা নির্ধারিত করে দেওয়া আছে। তাই চাইলেই ব্যাংকের মাধ্যমে এই টাকা পাঠানো যাবে।
অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্র-ছাত্রীদের বিদেশে পড়াশুনা করতে যাওয়ার সক্ষমতা প্রমাণ করার জন্য ব্যাংকের একাউন্টে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকাও জমা রাখতে হয়। এ সব কিছুর সাথে আয়করের কোন যোগাযোগ আছে কিনা তাও জানা যায় না। কিন্তু এই ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা ও জীবন যাপনের ব্যয় হিসেবে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানের ব্যবস্থা করে রাখা আছে সেটা এক কথায় বলা যায় কোনোভাবেই যথার্থ নয়। ফলে বিদেশে অধ্যয়নরতদেরও বাধ্য করা হয় বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করার জন্য হুন্ডি লাইনকে বেছে নিতে। এছাড়া তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। ফলে এই সমস্ত নীতিমালায় দেশকে একটি হুন্ডি চক্রের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলেছে। এটি এখন রূঢ় সত্য।
দেশের যেসব মানুষ এসব নিয়ম বা আইন তৈরি করেন তারাও বিষয়গুলো জানেন, কিন্তু তারা নিজেরাই এই দ্বিতীয় লাইনটি অনুসরণ করেন অর্থাৎ হুন্ডি ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে যান প্রকারান্তে। এছাড়া প্রচলিত উত্তরাধিকার আইনের কারণে আমাদের দেশের যেসব ব্যক্তি দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে বসবাস করছেন তারাও পারিবারিক উত্তরাধিকারীদের মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তি বাংলাদেশেই বিক্রি করেন এবং তাদের অর্থ পুরোপুরিভাবে মানিলন্ডারিং মাধ্যমে দেশ থেকে নিজের কাছে নিয়ে যান। কিভাবে নিয়ে যান? রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন যারা তারা সকলেই জানেন সম্পত্তি বিক্রির টাকা কোনো বৈধ বিদেশে যাচ্ছে না।
এক্ষেত্রে নাগরিকত্ব উত্তরাধিকার নিয়ে নতুন ধরনের করারোপ করা যেতে পারে। ভিনদেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন যারা তাদের ক্ষেত্রে আলাদা ব্যবস্থা এবং তাদেরকে বৈধভাবে টাকা প্রেরণের সুযোগ দিয়ে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা তৈরি করতে না পারলে এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকবে।
কাজেই ২৭টি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত ঘটনা অবাক করা কোনো ব্যাপার নয়। কিছুদিন আগে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে অতিরিক্ত মুনাফা করার অভিযোগেও কিছু ব্যাংকের কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তা কি যথেষ্ট?
বরং ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার আইনের প্রয়োগ হতে পারে কিনা, সেটা ভেবে দেখা উচিত। দেশের ভোক্তা অধিকার আইনের নজরে রয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা, যারা নিয়ম ভঙ্গ করে কোনো পণ্য বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কখনো কখনো তাদেরকে জেলে পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। কাজেই প্রশ্ন থেকেই যায় দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়মের বিরুদ্ধে যে বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা কি যথেষ্ট?