মশা দিবসে সকল মশাকে শুভেচ্ছা!
মশাদের প্রসঙ্গে কিছু পুরোনো গপ্পো বলা যাক...
ঔরঙ্গজেবের আমলে বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁ ইংরেজদের রীতিমত শায়েস্তা করে দিয়েছিলেন। ১৬৮২ সালে উইলিয়াম হজেস বাংলার প্রথম গভর্নর হয়ে এলেও বিশেষ খাপ খাওয়াতে পারেন নি। শায়েস্তা খাঁ-র কর্মচারিরা বিভিন্নভাবে তাদের বাধা দিত। কারণ অবশ্যই ছিল। ইংরেজরা কোম্পানির নামে বিনা মাসুলে ব্যবসা করে দেশীয় বণিকদের ভাতে মারছিল। শায়েস্তা খাঁ বললেন ইংরেজ বাংলা ছাড়ো। ইংরেজ ঠ্যাঁটা। তারা "ছাড়ব না, কি করবি করে নে" বলে নিজেদের কাজ করতে লাগল। এরই মধ্যে ১৬৮৩ সালের ২৮ অক্টোবর ইংরেজ কুঠির তিনজনকে হাটে একা পেয়ে শায়েস্তা খাঁয়ের লোকজন উদোম কেলিয়ে দেয়। একই সময় মুঘল ফৌজদার আব্দুল গনি ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করে পুড়িয়ে দিল।
সেখানের কর্মচারিদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জোব চার্নক। তিনি কিছু লোকলস্কর আর সৈন্য নিয়ে প্রথমে গার্ডেনরিচ পরে হিজলীতে ঘাঁটি গাড়লেন।
শায়েস্তা তাঁর সেনাপতি আব্দুল সামাদকে বললেন যাও চার্নককে তাড়িয়ে এস। সামাদ 'জো হুকুম, যাব আর আসব' বলে গেলেন আর হিজলীতে যুদ্ধ করতে গিয়ে হেরে ভূত হলেন। শান্তিচুক্তি স্থাপিত হল। ঠিক হল হুগলীতে কুঠি থাকবে আর উলুবেড়িয়ার ইংরেজরা বস্তি স্থাপন করবে। ১৬৮৭'র ১৭ জুন ইংরেজরা উলুবেড়িয়ায় হাজির হলেন নতুন শহর গড়বেন বলে। ২২ জুলাই শায়েস্তা খাঁ শর্ত মঞ্জুর করলেন। মাদ্রাজ থেকে কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টর-রা চার্নককে বললেন "দ্যাখো বাপু, বেশি উড়ো না। ভগবান সঙ্গে ছিলেন তাই জিতেছ। মুঘলদের পিছনে লাগতে যেও না"। ১৬৮৮ সালে ২৭ আগস্ট তারা আবার চার্নককে চিঠিতে লিখলেন, "আমরা উলুবেড়িয়ার জন্য ফরমান জোগাড়ের চেষ্টা চালাচ্ছি। ওখানে ডক বানানো সুবিধে। তুমি বাসস্থানের চেষ্টা চালাও।" এদিকে হিজলি থেকে উলুবেড়িয়া এসে তিন মাস অপেক্ষা করছেন চার্নক।
জায়গাটা তার একদম পোষায় নি। চারধারে উলুঘাসের বেড় দেওয়া, প্রচন্ড মশার উৎপাত, একেবারে বোরিং জায়গা। বরং উলটো দিকের সুতানুটি বেটার জায়গা। দুই বছর আগে মাদ্রাজ থেকে ভাগীরথী ধরে এখানেই প্রথম পা রেখে বড়দিনটা কাটিয়েছিলেন তিনি। এখানে হাট আছে।
জায়গাটাও অনেক বেশি সমৃদ্ধ। কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি ১৬৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে চার্নক আবার সুতানটি চলে আসেন। ইচ্ছে এখানেই শহর তৈরি করবেন।
এদিকে কোম্পানি চার্নককে জানালো। অনেক হয়েছে বস। এতদিনে কিছুই করতে পার নি যখন বাদ দাও। আমরা ক্যাপ্টেন হীথকে পাঠাচ্ছি। ও চট্টগ্রামে নতুন শহর বানাবে। হীথ ছিলেন বিশাল হামবড়া। বললেন, "চল হে, নতুন শহরের জায়গা খুঁজি"। চার্নক যতই বলেন "এটাই বেস্ট" উনি বলেন "তুমি বিশাল বিজ্ঞ হয়েচ?" ঝগড়া লাগল। শেষে বেচারা চার্নক প্রায় ছয়মাস ধরে হীথের সঙ্গে গোটা বাংলা জলপথে ট্যুর করেও মন মত জায়গা পেলেন না।
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৬৮৯-এ কোম্পানি বুঝে গেলে হিথকে পরিষ্কার বলে দিল "তুম সে না হো পায়েগা বেটা"। তারা চার্নককে লিখল "we have laid down our reasons for the altering our opinions about Ullaberreah and pitching on Chuttanutte as the best and fittest."
এদিকে বাংলার মসনদে বসেছেন নতুন নবাব ইব্রাহিম খাঁ। তিনি যখন পাটনার নবাব তখন চার্নক পাটনাতেই ছিলেন। তখন থেকেই দুজনের বন্ধুতা। ইব্রাহিম খাঁ চার্নককে খবর পাঠালেন "চলে এস বস। কোন চাপ নেই এখন।"
১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট, রবিবার দুপুর বারোটা নাগাদ প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে চার্নক তৃতীয়বার সুতানটিতে এলেন। সারাদিন জাহাজেই থেকে সন্ধে নাগাদ পা রাখলেন সুতানটির কাদামাখা মাটিতে। সঙ্গে ক্যাপ্টেন ব্রুক...
বাকি গল্পটা সবার জানা...
তাহলে মোরালটা কি খাড়াইল? উলুবেড়িয়ায় অমন ভয়ানক মশা না থাকলে কলকাতা নগর সেভাবে গড়েই উঠত কিনা সন্দেহ। অবশ্য তারপরেও শান্তি নেই।
বিলেত থেকে সাহেবরা কলকেতায় আসার পর যে দুটি জিনিস প্রথমেই তাদের পেরে ফেলত, এক, পেট খারাপ, আর দুই, এই মশা। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, মশার বিরাম নেই। সেই কবে ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, 'রেতে মশা, দিনে মাছি/ এই নিয়ে কলকেতায় আছি'। ১৮২৩ সালের ১৮ নভেম্বর বাবু রূপলাল মল্লিকের বাড়ি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে নাচের আসর বসেছিল। প্রধান গায়িকা ছিলেন 'প্রাচ্যের কাতলানি' ভিকি। কিন্তু নাচ দেখবেন কী! মশার উৎপাতে সাহেবরা নিজেরাই নেচে নেচে উঠছেন। গানের সঙ্গে মশার কামড়ের এই অনুপান খবরের কাগজ অবধি গিয়েছিল। এই মশার বিনবিনুনিতে অতিষ্ঠ হয়ে এক সাহেব মশার কবিতা অবধি লিখে ফেলেছিলেন। কিছুটা উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না..
'A ceaseless hum my listening ears regaled:
Mosquitos swarmed around, a thirsty thong
Raised the red bump, and tuned the hollow song
গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো মশার কামড়ে লবেজান। তার অ্যাডভোকেট জেনারেল স্মিথ সাহেব তাকে মশার হাত থেকে বাঁচার এক ঘরোয়া টোটকা দিলেন। "হিসেব করে এমন যুবক বা যুবতির পাশে গিয়ে বসুন, যিনি সদ্য লন্ডন থেকে এসেছেন। নিশ্চিত থাকুন মশারা আপনাকে ফেলে তারই রক্ত খেতে যাবে।" বুঝুন ঠেলা। তবে এ কথা যে ঠিক নয় তা প্রমাণিত মিস এমিলি ইডেনের দিনলিপিতে। তিনি লিখছেন, "স্যার মেটকাফ প্রায় তিরিশ বছর এই দেশে আছেন। এখনও ওকে মশা ঠিক ততটাই কামড়ায় যতটা তিরিশ বছর আগে কামড়াত।" কামড়ের ঠেলায় মেমসাহেবদের গলায় মুখে লাল লাল দাগ হয়ে যেত। তাই মশার হাত থেকে বাঁচতে তারা মাঝে মাঝেই হপ্তা দুই তিন পর্দানশিন থাকতেন। কোথাও বেরোতেন না।
মজার ব্যাপার, এই মশারা ছিল ভয়ানক দেশপ্রেমী। নেটিভদের নাকি তারা কামড়াতই না। এর পিছনে অবশ্য একটা কারণ আছে। শিল্পী চার্লস ও ডয়লি দারুণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, "দিনের শেষে সূর্য অস্ত গেলেই মশারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুনগুন শব্দে ইউরোপীয়দের বাড়িতে ঢুকে পড়ত। তাদের আওয়াজ শুনলে মনে হবে যেন তাঁতি তাঁত বুনছে। এ দেশের নেটিভরা ওই সময় উনানে আঁচ দিয়ে রাতের খাবার বানায়। সেই ধোঁয়ায় মশা টিকতে পারে না। অতএব তারা দলবল নিয়ে শহরের ইউরোপীয় অধ্যুষিত এলাকায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।" সত্যজিৎ রায়ের অসামান্য ভৌতিক গল্প 'নীল আতঙ্ক'-তেও ভারতের মশারা এসেছে। নীলকর সাহেব তার ডায়রিতে লিখছেন, "কানের কাছে আবার সেই রাক্ষুসে মশার বিনবুনুনি আরম্ভ হয়েছে। শেষটায় এই সামান্য একটা পোকার হাতে আমার মতোমত জাঁদরেল ব্রিটিশারকে পরাহত হতে হল? ভগবানের এ কেমন বিধি?"
তবে সবকিছুর ভালো দিকও আছে। এই মশারা না থাকলে সাহেবদের জিনের সঙ্গে অবশ্য পানীয় যে টনিক, তা বোধহয় আবিষ্কারই হত না। ষোড়শ শতকে আমেরিকার জেসুইট পাদরিরা খেয়াল করলেন যে, ওখানকার কোয়েচা রেড ইন্ডিয়ানরা সিঙ্কোনা নামে একটা গাছের ছালের তিতো রস খায়। সে রস খেলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ তো কমেই, এমনকি সেরেও যায়। তাদের হাত ধরে এই তিতো ছালের গাছ রোমে আসে। সেই সময় রোমে ম্যালেরিয়ার দারুণ প্রকোপ। একজন পোপ আর বেশ কিছু কার্ডিনাল মশার কামড়ে প্রাণ দিয়েছেন। সিঙ্কোনা গাছের ছালের রস খেয়ে বাকিরা অচিরেই সুস্থ হয়ে উঠলেন। সেই থেকেই ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত এলাকায় কেউ গেলেই তার কোঁচড়ে কিছু সিঙ্কোনা ছাল বেঁধে দেওয়া হত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা ভারতে এলে তাদেরকেও একইভাবে সিঙ্কোনার ছাল দেওয়া হয়েছিল। প্রথম প্রথম নিয়ম মেনে তারা জলে ভিজিয়ে খেতেন। তারপর সোডা ওয়াটারে। শেষে সেই সোডা ওয়াটারে জিন মিশিয়ে দেখলেন, আরে বাঃ, এ তো দারুণ অ্যাপারটিফ! খিদে বাড়ানো, ম্যালেরিয়াকে দূর হটানো, সব এক চুমুকে সম্ভব। এই নতুন তেতো তরলের নাম তারা দিলেন টনিক, মানে রোগহারক। সূর্য ডুবতে না ডুবতে মশা ঘিরে ফেলত চারদিক আর সাহেব মেমসাহেবরা সানডাউনার নামে এই জিন আর টনিক মিশিয়ে পান করতেন। তারপরেই আসত রাতের খাওয়া। কেমন করে যেন ইংরেজদের কালচারে এই জিন আর টনিক ঢুকে গেল। আজও খাঁটি ব্রিটেনে সাহেবরা ডিনার পার্টির আগে জিন আর টনিক খান, এটা না জেনেই যে, এর আসল কারণ ছিল ভারতের মশককুল।
অনেকদিন পরে ১৮৯৭ সালে আজকের দিনেই আমাদের কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেনারেল হাসপাতালে বসে এক বদমেজাজী ডাক্তার আবিষ্কার করেছিলেন এই ম্যালেরিয়ার পরজীবীর বাহক নাকি সেই মশা দীর্ঘনাসা। ডাক্তারের নাম রোনাল্ড রস।
আজ বিশ্ব মশক দিবস। সকল মশাদের শুভেচ্ছা জানাই।
[লেখকের ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত]