দেশবাসীর কাছে পুলিশের পক্ষ থেকে অনুরোধ
আমার এ লেখা যখন আপনি পড়ছেন, তখনও অনেক পুলিশ সদস্যকে তাদের ইউনিফর্ম খুলে আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছে। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা একটি বাহিনীর সদস্যদের এমন পরিণতি লজ্জার, হতাশার ও চরম অপমানের। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এটি আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন আজ পুলিশের ওপর জনগণের প্রবল ক্ষোভ আর তীব্র ঘৃণা জন্মেছে। এ কথা বলতে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু পুলিশ সদস্যের অতিরিক্ত রাজনৈতিক দলসম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডের ফল আজ সাধারণ পুলিশ সদস্যদের ভোগ করতে হচ্ছে।
কিছু কিছু পুলিশ সদস্য ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে এতটাই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়েছেন এবং ক্ষমতার চেয়ারের দাপটে তাদের অধীনস্তদের বিভিন্ন অন্যায্য ও অন্যায় কাজ করাতে বাধ্য হয়েছেন, যার ফলে পুলিশ আজ মানুষের কাছে প্রবল ক্ষোভের কারণে পরিণত হয়েছে। মানুষের এ ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এরপরেও কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করার জন্য সদয়ভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ পুলিশের প্রায় আড়াই লাখ সদস্য রয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, গত কয়েকদিনে পুলিশের দায়িত্বশীল পদে থাকা ব্যক্তিগণ কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ে না দিয়ে বরং পুলিশকে এ বিপ্লবী ছাত্রসমাজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। এমনকি যখন তারা জানতে পেরেছেন, সরকারের পতন নিশ্চিত, তখনও কোনো ধরনের তথ্য মাঠ পর্যায়ে প্রদান করেননি কিংবা কোনো ধরনের নির্দেশনা পর্যন্ত দেননি।
এ কারণে মাঠে থাকা পুলিশ সদস্যরা আরও বেশি বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হয়েছেন। অথচ পুলিশ সদস্যরা যদি এ বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা পেতেন, নিঃসন্দেহে এভাবে পুলিশকে আত্মগোপন করতে হতো না। বরং জনগণের এ আক্রোশ থেকে জীবন ও সরকারি সম্পদ বাঁচাতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেত।
এভাবে লাখো পুলিশ সদস্যকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ চরম দায়িত্বহীনতা ও অপেশাদার আচরণ করেছেন। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কাছ তাদের নেতৃত্ব প্রবলভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, কিছু পুলিশ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত লোভ, দলকানা কর্মকাণ্ড ও ইউনিফর্ম গায়ে জড়িয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষের মধ্যে সঞ্চিত হওয়া প্রবল ক্ষোভের বলি হচ্ছেন নিরপরাধ ও সাধারণ পুলিশ সদস্যগণ। সুযোগ বুঝে এরা [দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ কর্মকর্তা] ঠিকই সটকে পড়েছেন। কিন্তু বিপদের মুখে রেখে গেছেন অসহায় ও নিরপরাধ পুলিশ সদস্যদের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, তারা আজ মানুষের আক্রোশ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পুলিশের এমন পরিণতির জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক এটা সবার কাম্য। কিন্তু কিছু মানুষের অন্যায় কাজের শাস্তি দয়া করে পুরো পুলিশ বাহিনীকে দেবেন না। যারা অপরাধ করেছেন, তারা শাস্তি পাক। কিন্তু নিরপরাধ মানুষকে শাস্তি দেওয়া, হত্যা করা আরেকটি অন্যায়।
বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক না কেন, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। আপনি পুলিশকে পছন্দ করেন কিংবা না করেন, পুলিশকে আপনার প্রয়োজন হবেই। আমরা বিদেশে দেখেছি, মানুষ যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে সবার আগে পুলিশকে ডাকেন। বাংলাদেশেও তা-ই। ৯৯৯-এর মাধ্যমে আমরা প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষের ফোনকলে সাড়া দিই।
আমি জানি, পুলিশের সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু তা-ই বলে পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করা, নিরপরাধ পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রেখে পুলিশ সদস্যদের মনোবলকে দুর্বল করে দেওয়ার কারণে প্রবলভাবেই মানুষের জরুরি এ সেবা ব্যাহত হবে। বিশেষ করে, পুলিশ না থাকার সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্তদের একটি অংশ ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা করে অস্ত্র লুট করার চেষ্টা করছে। মানুষের সম্পদ কেড়ে নিচ্ছে।
এসব অস্ত্র-গুলি যদি অপরাধীদের হাতে চলে যায়, তা দিয়ে আরও ভয়ানক অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। বলা বাহুল্য, এতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সরকারের জন্য তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হবে।
একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি, জনগনের হাতে আইন তুলে নেওয়া যে কোনো রাষ্ট্রের জন্যই হুমকিস্বরূপ। কাজেই, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হয়, এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকুন। পুলিশের কেউ অপরাধ করলে বিদ্যমান আইনে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। দয়া করে আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। পুলিশের মতো জরুরি একটি জাতীয় সেবাকে বিপর্যস্ত করবেন না। এতে অনেক নিরীহ মানুষ ভুক্তভোগী হবেন। অপরাধীরা পুলিশের নিস্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করবে। এ বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থে দয়া করে পুলিশকে আক্রমণ থেকে বিরত থাকুন।
মো. ইমরান আহম্মেদ, পিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।