পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাস করি না, আওয়ামী লীগকে আত্মসমালোচনা নিয়ে ভাবতে হবে: সাক্ষাৎকারে সোহেল তাজ
সোহেল তাজ নামেই বেশি পরিচিত তানজিম আহমেদ। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিন আহমদের পুত্র। আওয়ামী লীগ থেকে ২০০১ এবং ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করলেও কয়েক মাসের মধ্যে হতাশা নিয়ে পদত্যাগ করেন।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি একজন নাগরিক হিসেবে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে খোঁজ নিতে সেখানে ছুটে গেলে অনেকদিন পর আবার আলোচনায় আসেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ফেসবুক লাইভে এসে তিনি আরও বেশি আলোচিত হতে থাকেন। তিনি আবার রাজনীতিতে ফিরছেন কি না এমন আলোচনা এখন সব জায়গাতে।
এমন প্রেক্ষাপটে সোহেল তাজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর পডকাস্টে টিবিএস-এর হেড অব ডিজিটাল জাহিদ নেওয়াজ খানের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেই আলাপচারিতা পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হলো।
টিবিএস: ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশকে আপনি কীভাবে দেখছেন? কেমন দেখছেন?
সোহেল তাজ: আমি যেটা মনে করি, আমি যখন রাজনীতিতে প্রবেশ করি তখন আমার চিন্তাধারা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা — একটি সমৃদ্ধশালী আধুনিক বাংলাদেশ যেখানে মেধা দিয়েই, মেধার ভিত্তিতে সবকিছু সমাধান হবে। আমাদের সবকিছুর মাপকাঠি হবে মেধা। এমন একটি সমাজ যেখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করব। এমন একটি দেশ যেখানে কোনো বিভেদ থাকবে না। ধনী-গরিব সবার সমান অধিকার থাকবে এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
আমি রাজনীতিতে ঢুকে খুবই হতাশ হয়েছিলাম। কারণ আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণভাবে অকেজো বা এগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে — আমি ১৯৯৮ সাল থেকে রাজনীতিতে — ২০০১ ও ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলাম। পরবর্তীকালে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলাম ২০০৯-এর জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত। আমার একটি উপলব্ধি ছিল, আমরা যদি এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোকে যদি কার্যকর, ঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারি, তাহলে এ রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আমাদের এ সহিংসতার সংস্কৃতি কোনোদিনই ঠিক হবে না। আমি বিশ্বাস করি, আজকে ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন হয়েছে, তাদের স্পিরিটটা কিন্তু আমার স্পিরিটের সঙ্গে একদম মিলে যায়। আমি এটাই চেয়েছিলাম।
টিবিএস: আমরা দেখেছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে যখন আটকে রাখা হয়েছিল, তখন আপনি গিয়েছিলেন।
সোহেল তাজ: আমি গিয়েছিলাম আমার বিবেকের কারণে। আমি টেলিভিশন ও গণমাধ্যমে দেখেছি, শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করা হচ্ছে। একটা আন্দোলনকে সহিংসভাবে দমন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সকল মানুষের মতো এটা আমার বিবেককেও নাড়া দিয়েছিল। আমার অবস্থান থেকে আমি মনে করেছিলাম, যেহেতু আমি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলাম এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ ছিল, তাই আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, যাতে কোনো বেআইনি, অন্যায় আদেশ তারা না মানেন। যাতে আর কোনো রক্তক্ষয় না হয়, আর কোনো ছাত্র-ছাত্রী ভাইবোনের প্রাণ যেন না যায়।
টিবিএস: মানে আপনি যা বলতে চাচ্ছেন — যে আন্দোলন হচ্ছিল সেটার স্পিরিট এবং আপনি আপনার মধ্যে যে স্পিরিটকে ধারণ করেন, দুটো একইরকম?
সোহেল তাজ: দ্যাট'স অ্যাবসলিউটলি রাইট [একদম ঠিক]। এটাই হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আজকে আমাদের শিক্ষার্থী ভাই-বোনরা যে 'কজ'টা নিয়ে এসেছে, একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়বে, এ স্পিরিটটাই কিন্তু ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। আমরা চেয়েছিলাম এমনই একটি দেশ। তারা যেটা আজকে বলছেন। সেই দেশের জন্যই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরা। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে, একাত্তরের পর, স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা মূল বিষয়টাকেই বাস্তবায়ন করতে পারিনি। যে কারণে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি, সেটাকেই আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।
টিবিএস: এবং স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আমাদের সে কথা বলতে হচ্ছে।
সোহেল তাজ: দ্যাট'স রাইট, দ্যাট'স রাইট [ঠিক, ঠিক]।
টিবিএস: কিন্তু এ আন্দোলনে বিজয়ের পর আমরা দেখেছি কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা হয়েছে। জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়েছে। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে এমন ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। আপনি বলছিলেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনাকে ধারণ করে। কিন্তু ওইসব ঘটনাও তো দেখা গেল। নিশ্চয় এটা আপনাকে পীড়া দিচ্ছে।
সোহেল তাজ: আসলে যেকোনো একটি গণঅভ্যুত্থানে, এ ধরনের আন্দোলনে মূল শক্তির সঙ্গে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল জড়িয়ে যায়। এটা পৃথিবীর সব জায়গায়ই হয়েছে। দুষ্কৃতিকারী কিছু গোষ্ঠী ঢুকে পড়ে। এবং তারা তাদের বিধ্বংসী রাজনীতিটা সেখানে হয়তো নিয়ে আসার চেষ্টা করে।
আমি প্রথমেই বলব, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আগুন দেওয়া, ভাস্কর্য ভাঙচুর করা — আমি এসবের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কারণ বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতায় ২৩ বছর নেতৃত্ব দিয়ে বাংলার মানুষকে প্রস্তুত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল, সে মুহূর্ত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় কিন্তু বাংলার মানুষ জাগ্রত হয়েছিলেন।
আমাদের সঠিক ইতিহাসগুলোকে আমাদেরই কিন্তু সংরক্ষণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি জ্বলন্ত অংশ। প্রতিকৃতি এবং উনার বাসভবন ধ্বংস করার ঘটনা দুঃখজনক শুধু নয়, নিন্দনীয় এবং এটি একটি অপরাধ। এটি আমাদের দেশের সম্পদ ধ্বংস করা এবং দেশের অস্তিত্ব মুছে ফেলার চেষ্টারই একটি চিহ্ন।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা ভাইবোন, যারা একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে চান, তারা কেউই এটি করেনি। আমি বিশ্বাস করি, অন্য এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চাওয়া একটি স্বার্থান্বেষী মহলের কাজ এটি।
টিবিএস: আপনি যে আন্দোলনকারীদের কথা বলছেন, আমরা দেখেছি এ ছেলেমেয়েরাই কিন্তু বঙ্গবন্ধু ভবন পাহারা দিচ্ছে, প্রতিকৃতি পরিস্কার করছে এবং যতটুকু সম্ভব নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এরাই তো তারা, যারা মূল আন্দোলনের চেতনা নিয়ে এসেছিল?
সোহেল তাজ: দ্যাট ইজ অ্যাবসলিউটলি রাইট। আমিও সেটাই বলছি। ছাত্র-ছাত্রী যারা আন্দোলন করেছে, তারা একটি সুন্দর বাংলাদেশ চেয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, একটি স্বার্থান্বেষী মহল একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে তাদের এজেন্ডা নিয়ে কাজ করেছে। এটা জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমি দাবি করছি, কারা এসব করেছে তা বের করে অতি দ্রুত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক।
টিবিএস: সোহেল তাজ, আপনার কাছে শেষ প্রশ্ন। আপনি এক সময় আওয়ামী লীগ করতেন। তারপর হতাশ হয়েছেন। রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। কিন্তু মানুষ তো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক এলিমেন্ট। তাছাড়া আপনার পরিবারের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। আপনার বাবা বাংলাদেশের জাতীয় নেতা, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনার মা দুঃসময়ে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করেছেন। এখন এ মুহূর্তে আপনার কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা আছে কি না?
সোহেল তাজ: প্রথমত আমি পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাস করি না। আমি চেষ্টা করেছি আমার নিজের যোগ্যতা দিয়ে রাজনীতি করার জন্য। আমি এমনটা বিশ্বাস করি না যে, আমার বাবা এটা করেছেন বা আমার মা ওটা করেছেন, এজন্য আমাকেও করতে হবে। আমি যদি দেশের নাগরিক হিসেবে মনে করি আমি অবদান রাখতে পারব, তাহলে আমি কাজ করব। জনগণ যদি চায়, তাহলে আমি কাজ করব।
টিবিএস: অনেকে মনে করছেন, আপনি হয়তো আবার আওয়ামী লীগেই সক্রিয় হবেন অথবা আপনি একটি দল গঠন করবেন। কোনো সম্ভাবনা আছে?
সোহেল তাজ: আমি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমি রাজনীতির বাইরেই আছি এবং রাজনীতির বাইরেই থাকব। কারণ আমার বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে, আমার দল, দলের কী অবস্থা — এরকম অনেক বিষয় আছে যেগুলো পর্যবেক্ষণের দরকার। আমি মনে করি, আমাদের দলের আত্মোপলব্ধি এবং আত্মসমালোচনার অনেক ক্ষেত্র আছে, যেটা এখন পর্যন্ত আমরা করিনি। আর সেটা না করলে ভবিষ্যতের পথে কীভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেবে, আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না।
টিবিএস: আমরা এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে খুব একটা প্রতিক্রিয়া পাইনি। এখন পর্যন্ত যতটুকু পেয়েছি, তাতে এত এত মৃত্যুর জন্য কাউকে দুঃখ প্রকাশও করতে দেখিনি।
সোহেল তাজ: দ্যাট'স কারেক্ট [সেটা ঠিক]। এখানেই আমি বলছি যে, আত্মোপলব্ধি এবং আত্মসমালোচনা দরকার। সুতরাং, এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক আমরা যদি নিজের জবাবদিহিতা না নেই, আমরা যদি নিজেকে বোঝার চেষ্টা না করি এবং নিজের ভুল-ত্রুটি যদি আমরা বিশ্লেষণ না করতে পারি, তাহলে — এটা তো কোনো সুফল বয়ে আনেনি কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য — এবং এক্ষেত্রেও আনবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।
টিবিএস: সোহেল তাজ, আপনাকে ধন্যবাদ টিবিএসকে সময় দেওয়ার জন্য।
সোহেল তাজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।