তাদের ফেরার অবসান হয়েছে, ফেরার জন্য অপেক্ষারও
কারও বাবা আর কখনোই ফিরবেন না। কখনোই ফিরবে না অনেক মা-বাবার সন্তান।
একমাস আগেও ওই বাবারা সবাই জলজ্ব্যান্ত মানুষ ছিলেন। কাজ শেষে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতেন সন্তানের জন্য চকোলেট বা আইসক্রিম নিয়ে। সারাদিন সন্তান অপেক্ষায় থাকত। কখন ফিরবে বাবা, কখন তার কোলে বা কাঁধে চড়া। স্ত্রী অপেক্ষায় থাকতেন প্রিয় মুখটির জন্য।
যেমন প্রিয়মুখ সন্তানের জন্য অপেক্ষায় থাকতেন মা-বাবা। ক্লাস-আড্ডাপর্ব শেষ করে দিনশেষে ঘরে ফিরত সন্তান। কিংবা কয়েক মাস পর হোস্টেল বা হল থেকে তাদের ফেরা। প্রিয় সন্তানের ফেরার জন্য প্রতিদিন কিংবা অনেকগুলো দিন মা-বাবার প্রতীক্ষা। ওই সন্তানেরা আর কখনোই ফিরবে না। শত অপেক্ষাতেও তাদের মা-বাবা আর কখনোই দেখবেন না সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে কাঙ্খিত মুখ।
তাদের সবার ফেরার অবসান হয়েছে। অবসান হয়েছে তাদের ফেরার জন্য অপেক্ষারও।
মাত্র এক মাসের মধ্যে সাড়ে ছয়শ মানুষ চিরতরে হারিয়ে গেছেন। তারা এখন চিরঘুমের দেশে। কেউ ঘুমিয়ে আছেন বাড়ির ঠিক দোরগোড়ায়। কেউ পারিবারিক বা এলাকার কবরস্থানে। আর শোকে নিঃস্ব হয়ে আছেন তাদের মা-বাবা-সন্তান-স্ত্রী-পরিজন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ মানবাাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৬০০ মানুষ নিহত হয়েছেন।
'বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও অস্থিরতার প্রাথমিক বিশ্লেষণ' শীর্ষক জাতিসংঘ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪০০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আর ৫ ও ৬ আগস্ট নিহত হয়েছেন ২৫০ জন।
এছাড়াও ৭ থেকে ১১ আগস্টের মধ্যে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে সহিংসতায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তিরাও রয়েছেন।'
জাতিসংঘ বলছে, নিহতদের মধ্যে আন্দোলনকারী, পথচারী ও সাংবাদিকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রয়েছেন। আহতদের মধ্যে রয়েছেন হাজার হাজার আন্দোলনকারী ও পথচারী।
হাসপাতালে আহতদেরও কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন প্রতিদিন। ১৬ জুলাই শুরু হওয়া মৃত্যুর তালিকা এখনো বড় হচ্ছে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখেছিলেন:
'এ-কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন,
শিয়রে যাহার ওঠে না কান্না, ঝরে না অশ্রু?
হিমালয় থেকে সাগর অবধি সহসা বরং
সকল বেদনা হয়ে ওঠে এক পতাকার রং
এ-কোন মৃত্যু? কেউ কি দেখেছে মৃত্যু এমন।'
দুই হাজার চব্বিশে যা ঘটেছে, এমন মৃত্যু আর কখনোই দেখেনি বাংলাদেশ। এত অল্প সময়ে গুলিতে এত মানুষের মৃত্যু!
আমরা কেউ নিজের চোখে ওই মৃত্যু দেখেছি, কেউ মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিওচিত্রে। একদল উন্মাদ যেন মৃত্যুর উৎসবে মেতেছিল।
নিরস্ত্র মানুষকে তারা একবার গুলি করেছে, দুইবার গুলি করেছে, ছয়বার গুলি করেছে। তারা সরাসরি হৃদযন্ত্র বরাবর গুলি করেছে। চোখ-কপাল-মাথা তাক করে গুলি করেছে।
আশ্রয়ের সন্ধানে কার্নিশে ঝুলতে থাকা যুবককে তারা গুলি করেছে। রোড ডিভাইডারের আড়ালে আশ্রয় নেওয়া শিশুকে গুলি করেছে। আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ারে ঝুলতে থাকা তরুণকে গুলি করেছে। তারপর রাস্তায় ছুড়ে ফেলে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আবার গুলি করেছে।
তারা মানুষের ভিড়ে পানি বিলোনো তরুণকে গুলি করেছে। তারা হাজারো মানুষের মিছিলে গুলি করেছে। তারা মাথা লক্ষ্য করে জমায়েতে গুলি চালিয়েছে।
তাদের কাছে এ যেন এক মৃত্যু উৎসব। কে কত বেশি গুলি করে কত বেশি মানুষকে মেরে ফেলতে পারে তার প্রতিযোগিতা।
তাদের হাত একবারও কাঁপেনি। তারা পিঁপড়া পিষে ফেলার মতো বুলেটে মানুষের শরীর ঝাঁঝরা করে দিয়েছে।
যে মানুষগুলোকে তারা এভাবে মেরে ফেলেছে, তাদেরকে কি ওদের মানুষ মনে হয়নি! তাদের একবারও মনে হয়নি ওই বয়েসি আমার ছেলে আছে, ভাই আছে, পিতা আছে!
না, তাদের তা মনে হয়নি। তাদের মনে হয়েছে, এ মানুষগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। তারা সেটা করেছে।
এটাতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল না, এটা গাজায় ইসরায়েলী বাহিনীর হামলাও ছিল না। এটা ছিল তাদের দেশের মানুষেরই বিক্ষোভ। খুনিদের কাছে সে বিক্ষোভকারীদের নিজ দেশের মানুষ মনে হয়নি। ওই মানুষগুলোকে মানুষই মনে হয়নি তাদের কাছে।
গুলি করতে তাই তাদের হাত কাঁপেনি। চোখ কাঁপেনি। একটার পর একটা গুলি করেছে। অবলীলায় তারা নিজের সন্তানের মতো শিশু-কিশোর-তরুণের বুকে গুলি করেছে। নিজের ভাইয়ের মতো মধ্যবয়সি বা পিতার মতো প্রৌঢ়কে গুলি করেছে। এমনকি হেলিকপ্টার থেকে নিজের সন্তানের বয়েসি শিশুকে গুলি করেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নিজের বোনের মতো তরুণী বা মধ্যবয়েসি নারীকে গুলি করেছে।
তারা দুহাত দুদিকে দিয়ে প্রতিবাদ জানানো আবু সাঈদকে হত্যা করে খুনের উৎসব শুরু করেছিল। কিন্তু, মানুষ তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আর পিছোতে পারে না। মিছিল তাই বড় হয়েছে। মিছিল যত বড় হয়েছে, তত বেশি গুলি করেছে তারা। মিছিল তাতে আরও বড় হয়েছে।
তবু তারা থেমে যায়নি। পুলিশ কমিশনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইল ফোনে ভিডিও দেখাতে দেখাতে বলেছেন, গুলি করলে একজন আহত হয়, একজন নিহত হয়। কিন্ত মিছিল থেমে যায় না। মিছিল আরও বড় হয়। এটাই সমস্যা।
সে সমস্যা তারা গুলিতেই মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। নির্মমতা-অমানবিকতার পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচুতে উঠে তারা ভেবেছিল, এভাবেই থেমে যাবে সব।
থামেনি।
আজ সরকারের পতন নিয়ে আমরা অনেক বিশ্লেষণ করতে পারি। হাজারটা কারণ বের করতে পারি। কিন্তু, একটিই কারণ যদি আমরা খুঁজতে চাই, সেটা এ হত্যাকাণ্ড — গণহত্যা।
এক দিয়ে শুরু হয়েছিল। ওরা ভেবেছিল কয়েকজন বা কয়েক ডজন দিয়েই সেটা থামিয়ে দেওয়া যাবে। এজন্যই তো এত হত্যাকাণ্ড, হত্যার এত আয়োজন।
কিন্তু, মানুষ যখন মরতে শেখে তখন মৃত্যু আর তার মিছিল থামাতে পারে না। পতনও ঠেকাতে পারে না মৃত্যুকে মৃত্যুর মিছিল বানানো নির্দেশদাতার।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমরা হয়তো বলতে পারি:
'জয় হোক জয় হোক মরণের জয় হোক
আমাদের অনন্ত মরণ
মরণের হবে না মরণ।'
কিন্তু, পাঁচ বছর বয়েসি যে সন্তান এখনো তার পিতার অপেক্ষায় থাকে! ঘুম থেকে জেগেই যে শিশু কিছু না বুঝেও জেনেছে হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গোলায় মা তার আকাশের তারা হয়ে গেছেন! যে মা কোনো একটা অসম্ভবের সম্ভাবনায় প্রিয়তম সন্তানের অপেক্ষায় থাকেন! যে পিতা নিজের কাঁধে তার সন্তানের লাশ বহন করেছেন? যে ভাই তার ভাইয়ের কবরে বিছিয়ে দিয়েছেন এক টুকরো মাটি! যে বোন জনম জনম রাখবে ধরে ভাই হারানোর জ্বালা!
তারা কি অভিশাপ দিচ্ছেন? তারা কি অভিশাপ দিতে থাকবেন?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।